দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ রাজ্যে রেশন ব্যবস্থার ‘অনিয়ম’ থেকে শুরু করে কেন্দ্রের পাঠানো টিমের ‘অসহযোগিতা’র প্রশ্নে গত কয়েক দিন ধরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের একপ্রকার সমালোচনায় অবতীর্ণ রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরামর্শ দেওয়া বা সতর্ক করার মোড়কে তিনি যা বলে চলেছেন, তা আসলও সমালোচনার নামান্তর বলেই মত অনেকের। তা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী পাল্টা জবাব দেওয়া থেকে বিরতই ছিলেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজ্যপালকে চিঠি দিয়ে বেনজির আক্রমণ করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
জগদীপ ধনকড়কে দীর্ঘ চিঠি লিখে মমতা বলেন, “আপনি হয়তো ভুলে গিয়েছেন, আমি ভারতের গর্বিত এক রাজ্যের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী। আপনি হয়তো এও ভুলে গিয়েছেন যে আপনি একজন মনোনীত রাজ্যপাল। আপনি আমার সরকার বা মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরামর্শ বা ইনপুট নাও গ্রহণ করতে পারেন (পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপাল পদের দায়িত্ব নেওয়ার পর যা আপনি আকছার করছেন) কিন্তু ১৯৪৯ সালের ৩১ মে সংবিধান সভায় দাঁড়িয়ে বাবা সাহেব আম্বেদকর যে কথা বলেছিলেন, তা আপনার উপেক্ষা করা উচিত নয়।”
এ কথা বলে, সংবিধান সভায় রাজ্যপালদের অধিকার প্রসঙ্গে আম্বেদকরের মত, উদ্ধৃত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন, আঞ্চলিক সরকারের দৈনন্দিন বিষয়ে নাক গলানোর কোনও অধিকার নেই রাজ্যপালের। বস্তুত রাজ্যপালের সেই অর্থে কোনও ভূমিকাই নেই। এ ছাড়াও সরকারিয়া কমিশনের প্রসঙ্গও চিঠিতে উল্লেখ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
রাজ্যপালকে লেখা মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি থেকেই জানা গিয়েছে যে গত কয়েক দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধারাবাহিক ভাবে কয়েকটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন ধনকড়। ২২ এপ্রিল বুধবার সকাল সাতটার সময় মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্যপাল একটি টেক্সট মেসেজও করেছিলেন। সেই মেসেজ এদিন চিঠিতে হুবহু তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সঙ্গে বলেন, যে নজিবিহীন ভাষা ও মেজাজে আপনি এসএমএস করেছেন তা আরও একবার এখানে তুলে ধরা দরকার।
মমতাকে এসএসএম করে রাজ্যপাল লিখেছিলেন, “আপনার গতকালের জবাব দেখে ভীষণ অবাক হয়েছি। তাতে আমার পদের অবমাননা হয়েছে। আমরা দু’জনেই সাংবিধানিক পদে রয়েছি। এটা কারও জমিদারি নয় যে তাঁর খেয়ালখুশি মতো চলবে।”
রাজ্যপালের এ হেন শব্দ চয়নের তীব্র সমালোচনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে এই ধরনের শব্দ কীভাবে ব্যবহার করতে পারেন একজন রাজ্যপাল। এটা শুধু অসাংবিধানিক নয়, তার থেকেও বেশি।
মমতার কথায়, “এ বার আপনি নিজেই বিচার করুন আপনি সংবিধান সম্মত কাজ করছেন কিনা। আপনি যেভাবে আমাকে আক্রমণ করছেন, সরকারের মন্ত্রীদের সমালোচনা করছেন, সাংবাদিক বৈঠক করে সরকারের সমালোচনা করছেন, যে ভাষায় চিঠি লিখছেন তা কতটা রাজ্যপাল সুলভ।”
মুখ্যমন্ত্রীর ওই চিঠি পেয়ে রাজ্যপাল একটি টুইট করেন। তিনি বলেন, আমি রাতেই এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাব। তার পর কাল আরও বিশদে বলব। রাজ্যের মানুষের সবটা জানা দরকার।
A communication @MamataOfficial has been received.
— Governor West Bengal Jagdeep Dhankhar (@jdhankhar1) April 23, 2020
Outrageously factually wrong and constitutionally infirm.
My initial response will be shared with media around 7.45 PM today.
And a final one tomorrow at 11 am.
People of the state need to know the real picture.
শঠে শাঠ্যং যে অবধারিত সেই দেওয়াল লিখন পরিষ্কারই ছিল। হলও তাই। রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়কে নজিরবিহীন আক্রমণ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চিঠি লেখার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া এল রাজভবন থেকে। মুখ্যমন্ত্রী রাতেই পাল্টা একটি চিঠি পাঠিয়ে রাজ্যপাল অভিযোগ করেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই সাংবিধানিক শর্ত মেনে রাজ্য চালাচ্ছেন না। চিঠিতে পোড় খাওয়া প্রাক্তন আইনজীবী এও লিখেছেন, “কোনও সাংবিধানিক পদাধিকারীকে নিজেই আইন হয়ে ওঠার অধিকার সংবিধান দেয়নি। জমিদারির মতো রাজ্য চালানো যায় না। তা সাংবিধানিক শর্ত মেনেই চালাতে হয়।”
রাজ্যপালের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর লেখা চিঠির বয়ান কঠোর ছিল বলেই অনেকের মত। চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, “আপনি হয়তো ভুলে গিয়েছেন, আমি ভারতের গর্বিত এক রাজ্যের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী। আপনি হয়তো এও ভুলে গিয়েছেন যে আপনি একজন মনোনীত রাজ্যপাল। আপনি আমার সরকার বা মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরামর্শ বা ইনপুট নাও গ্রহণ করতে পারেন (পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপাল পদের দায়িত্ব নেওয়ার পর যা আপনি আকছার করছেন) কিন্তু ১৯৪৯ সালের ৩১ মে সংবিধান সভায় দাঁড়িয়ে বাবা সাহেব আম্বেদকর যে কথা বলেছিলেন, তা আপনার উপেক্ষা করা উচিত নয়।”
তা ছাড়া তাঁকে পাঠানো রাজ্যপালের এর আগের সব চিঠি ও টেক্সট মেসেজে যে ধরনের ভাষার প্রয়োগ করা হয়েছে তার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ওই সব শব্দকে অসাংবিধানিক বললেও কম কথা হয়। প্রসঙ্গত, ২২ এপ্রিল মুখ্যমন্ত্রীকে পাঠানো বার্তায় রাজ্যপাল লিখেছিলেন, “আপনার গতকালের জবাব দেখে ভীষণ অবাক হয়েছি। তাতে আমার পদের অবমাননা হয়েছে। আমরা দু’জনেই সাংবিধানিক পদে রয়েছি। এটা কারও জমিদারি নয় যে তাঁর খেয়ালখুশি মতো চলবে।”
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর চিঠির পরেও রাজ্যপাল তাঁর এদিনের চিঠিতে ফের ‘জমিদারি’ শব্দটি ব্যবহার করে হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন তিনিও রণে ভঙ্গ দেওয়ার পাত্র নন।
এদিনের চিঠিতে রাজ্যপাল লিখেছেন, “আপনাকে ভাল করে এটা জানানো দরকার যে সাংবিধানিক রীতিনীতি মেনে চলতে আপনি আগাগোড়া ব্যর্থ। আপনাকে এর আগে যত চিঠি পাঠিয়েছি তা যেন সব ব্ল্যাক হোলে চলে গিয়েছে। কোনও জবাব পাইনি। যা সংবিধানের ১৬৬ ও ১৬৭ ধারার পরিপন্থী।”
রাজ্যপালের কথায়, আপনি যেমন সংবিধানের নামে শপথ নিয়েছেন। তেমনই আমিও সংবিধানের ১৫৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী এই শপথ নিয়েছি যে, “দেশের সংবিধান ও আইনকে রক্ষা করতে আমি যথাসাধ্য করব। সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কল্যাণের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করব।”
রাজ্যপালের অভিযোগ, শুধু মুখ্যমন্ত্রী নন, বর্তমান সরকারের অফিসারদের অনেকেই সাংবিধানিক নিয়মের তোয়াক্কা করেন না। রাজ্যপাল চিঠি লিখলে ন্যূনতম জবাবটুকুও দেওয়া হয় না। ধনকড়ের কথায়, “আপনার বক্তব্য পড়ে মনে হচ্ছে যে আপনি চান, রাজ্যপাল ‘স্লিপ মোডে’ চলে যাক। একেবারে অকেজো হয়ে রাজভবনের মধ্যেই সীমিত থাকুক।”
এ কথা বলে রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীকে পাঠানো একটি টেক্সট মেসেজও উদ্ধৃত করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথোপকথনের পর সেই এসএমএস করেছিলেন রাজ্যপাল। তাতে তিনি বলেছেন, “আপনি যেভাবে উত্তেজিত হয়ে কথা বলেছেন তা ঠিক মনে করছি না। এখন শান্ত হয়ে আলোচনার সময়। রাজ্য যখন একটা সংকট ও চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তখন রাজ্যপাল স্লিপ মোডে থাকতে পারে না। রাজ্যপালের সঙ্গে কেন সংঘাতের রাস্তা নিচ্ছেন। ব্যক্তিগত সম্পর্ক খারাপ হওয়া উচিত নয়।”
এদিন মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্যপাল চিঠিতে জানিয়েছেন, এটা হল তাঁর প্রাথমিক জবাব। কাল ফের বিস্তারিত জবাব দেবেন তিনি।
যার অর্থ পরিষ্কার। নবান্ন-রাজভবন সংঘাত আগামী দিনে তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।