‘মন কি বাত’-এ মোদীর মুখে ১৯ শতকের বাংলার এক বিস্মৃত কবি মনোমোহন বসুর বাংলা কবিতা

0
720

দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ বাংলার মানুষের মন ছোঁয়ার চেষ্টায় ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে ইদানীং হামেশাই বাংলার বিভিন্ন প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বিশেষ করে বাংলার মনীষীদের, বাংলার অতীত ঐতিহ্যের কথা বলেন তিনি। রবিবার তিনি অগ্নিযুগের বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ ও উনিশ শতকের কবি মনোমোহন বসুর কথা বলেছেন। উনিশ শতকের ওই কবিকে অনেকেরই মনে নেই। মোদী এ দিন তাঁর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচি কিংবা ‘ভোকাল ফর লোকাল’ প্রচারের সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়কার স্বদেশি পণ্য তৈরি ও ব্যবহারের পক্ষে আন্দোলনের সাযুজ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

হালে ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাবনাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। ভারতে খেলনা শিল্পের প্রসারের বিষয়ে মোদী বলেছিলেন, বিশ্বকবি মনে করতেন, সেটাই আদর্শ খেলনা, যা অসম্পূর্ণ। খেলতে খেলতে বাচ্চারা তাকে পূর্ণতা দেবে। এ বার দুর্গাপুজোর বোধন তথা ষষ্ঠীর দিন বাংলার মানুষের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী যে ভার্চুয়াল বক্তৃতা দেন, তার ছত্রে ছত্রেই ছিল বাংলা ও বাঙালির হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের কথা।

বিরোধীদের বক্তব্য, বাংলার মন কাড়ার লক্ষ্যে মোদীর এই চেষ্টা পুরোপুরি রাজনৈতিক এবং বিধানসভা ভোট যত এগিয়ে আসছে, ততই তাঁর বাংলা প্রীতি ক্রমশ লোকদেখানো হয়ে যাচ্ছে। তৃণমূলের এক রাজ্যনেতার কথায়, ‘বিধানসভা ভোটে রাজ্যের নেতাদের উপর ভরসা না-করে বিজেপি গোটা দায়িত্ব তুলে দিয়েছে ভিন রাজ্যের নেতাদের হাতে। বিজেপি বাঙালির পার্টি নয়- আমাদের এই প্রচারও বিপাকে ফেলেছে গেরুয়া শিবিরকে। সেই কারণে প্রধানমন্ত্রী বার বার দেখাতে চাইছেন, তাঁর দলের বাংলা ও বাঙালি প্রীতি কতটা নির্ভেজাল!’

রবিবার ‘মন কি বাত’ শেষ হওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী উত্থাপন করেন অরবিন্দ ঘোষের প্রসঙ্গ। এই বছর অগ্নিযুগের ওই বিপ্লবীর মৃত্যুর ৭০ বছর। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৫ ডিসেম্বর অরবিন্দর মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর লেখার মধ্যেই আছে অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচনের পথ। তরুণ প্রজন্ম তাঁর সম্পর্কে যত জানবে, ততই শিখবে। তাদের জ্ঞানভাণ্ডার মজবুত হবে। মিলবে নতুন পথের সন্ধান।’ প্রধানমন্ত্রীর কথায়, ‘আমাদের ভোকাল ফর লোকাল প্রচারে অরবিন্দের স্বদেশি দর্শন পথ দেখাচ্ছে’। অববিন্দর স্বদেশিয়ানা ও শিক্ষা ভাবনার বিষয়ে দেশবাসীকে পড়াশোনা করার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রসঙ্গত, অরবিন্দর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর রাজ্যের মানুষেরও বিশেষ যোগ রয়েছে। অরবিন্দ প্রায় ১৩ বছর অধুনা গুজরাটের অন্তর্গত বরোদায় শিক্ষকতা-সহ নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

স্বদেশিয়ানার প্রসঙ্গেই এ দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উনিশ শতকের কবি মনোমোহন বসুর ‘দিনের দিন্ সবে দীন’ কবিতার দু’টো পংক্তি বাংলাতেই পড়ে শোনান। তার পর পংক্তি দু’টির হিন্দি তর্জমা করেও শোনান তিনি। মোদীর বক্তব্য, বাংলায় একটি বিখ্যাত কবিতা আছে- ‘ছুঁই সূতো পর্যন্ত আসে তুঙ্গ হ’তে, দীয়াশলাই কাটি, তাও আসে পোতে/ প্রদীপটি জ্বালিতে, খেতে, শুতে, যেতে, কিছুতেই লোক নয় স্বাধীন!’ কবির আক্ষেপ, সুচ-সুতো থেকে দেশলাই কাঠি, সবই ছিল বিদেশি পণ্য। খাওয়া, জল পান করা, এমনকী ঘুমোনোরও স্বাধীনতা ছিল না। কবি ছাড়াও মনোমোহন বসু ছিলেন নাট্যকার, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক। তাঁর জন্ম অধুনা নদিয়া জেলার বড়জাগুলিতে।

কিন্তু মনোমোহনের এই কবিতা কেন মোদীর মুখে? সংবাদমাধ্যমে এ কালের কবি সুবোধ সরকারের বক্তব্য, ‘পরাধীনতার যন্ত্রণা নিয়ে গোটা জীবন কাটিয়েছেন মনোমোহন। কবির লেখা ওই কবিতায় জাতীয়তাবাদের ভাবাবেগ ফুটে উঠেছে। হতে পারে, মোদী নিজের স্বনির্ভর ভারত গড়ে তোলার পরিকল্পনাকে তার সঙ্গে জুড়তে চেয়েছেন। তবে মনোমোহনের অনুভূতির সঙ্গে এখনকার বিভাজনের রাজনীতির কোনও সংযোগ নেই।’

প্রধানমন্ত্রী এ দিন বলেন, ‘আমরা স্বদেশি বলতে বোঝাতে চাইছি, ভারতে, ভারতীয়দের তৈরি জিনিস ব্যবহারে উৎসাহ জোগাতে।’ তবে সেই সঙ্গে মোদীর বক্তব্য, ‘অরবিন্দ কিন্তু বিদেশ থেকে শিক্ষা নেওয়ার বিরুদ্ধাচরণ করেননি। আমরাও নতুন কিছু শেখার কথাই বলছি। আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তুলতে যা কিছু ভালো, তা সবই আমরা গ্রহণ করব।’

প্রসঙ্গত, রবিবার প্রধানমন্ত্রী মনোমোহনের যে কবিতাটি উদ্ধৃত করেছেন, তা ১৯৫৯ সালে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অরুণকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংকলিত এবং সম্পাদিত ‘উনবিংশ শতকের গীতিকবিতা সংকলন’-এ প্রকাশিত ‘দিনের দিন্ সবে দীন’ কবিতার অংশ। বিদেশি দ্রব্য বর্জনের সপক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে “ছুঁই সূতো পর্যন্ত আসে তুঙ্গ হ’তে, দীয়াশলাই কাটি, তাও আসে পোতে/ প্রদীপটি জ্বালিতে, খেতে, শুতে, যেতে, কিছুতেই লোক নয় স্বাধীন!” ছত্রগুলি লেখেন তিনি।

বাংলায় সেই ছত্রগুলি পাঠ করার পাশাপাশি রবিবার সেটির হিন্দি তর্জমাও করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘‘অর্থাৎ, সুচ-সুতো থেকে দেশলাই কাঠি সবই আসত বিদেশ থেকে। খাওয়া, জল পান করা, এমনকি ঘুমনোতেও স্বাধীনতা ছিল না। আমরা স্বদেশি বলতে বোঝাতে চাইছি, ভারতে তৈরি, ভারতীয়দের তৈরি জিনিস ব্যবহারের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।’’

আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গ নজরে গেরুয়া শিবিরের। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, বাংলার মানুষের কথা মাথায় রেখেই হয়তো অরবিন্দের কথা বলার পর বাঙালি কবিকে বেছে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। 

Previous articleআজ বছরের শেষ চন্দ্র গ্রহণ কখন-কোথায় দেখা মিলবে ?
Next articleদুয়ারে দুয়ারে সরকার! কর্মসূচি কেন?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here