৷৷ নাস্তিক-আস্তিক এর দ্বন্দ্ব।।
কাকতালীয় হলেও শনিবার সন্ধ্যায় হাঁটাহাঁটি করে বাড়ি ঢোকার সময়, বিল্ডিংয়ের কেয়ারটেকার আমার হাতে একটা প্যাকেট দিলেন। স্নান করে প্যাকেটটা খুলে দেখি একটা বই – “Shri Ram Krishna (a divine Life in pictures)”
বইটি স্বামী চেতনানন্দের লেখা। সেন্ট লুইস থেকে আমাকে পাঠিয়েছেন। ইংরেজি ভাষায় লেখা এই বইতে ঠাকুর রামকৃষ্ণ যেখানে যেখানে গেছেন, সেখানকার ছবি ও কী করেছেন তার যাবতীয় বৃত্তান্ত লেখা আছে। এমনকি বিদেশি ভক্তরাও রামকৃষ্ণকে ব্যাখ্যা করেছেন। এককথায় অনবদ্য এই বই। দাম : ৩০০০ টাকা।
বইটা পেয়ে খুব আনন্দ হলো। কিন্তু আমার মত নাস্তিক লোকের হটাৎ এমন বইপ্রাপ্তির গল্পটা এইরকম – ২০২০ তে লকডাউন এর সময় আমার প্রতিবেশী কৃষি বিজ্ঞানী সত্যব্রত গাঙ্গুলী আমার বাড়িতে এসে বললেন, “স্বামী চেতনানন্দ আমায় বলেছেন ওনার বইয়ের জন্য কিছু ছবি আপনাকে তুলে দিতে হবে।”
স্বামী চেতনানন্দ বিদেশে থাকেন। সেন্ট বেদান্ত সোসাইটি, সেন্ট লুইস, ইউকে, ইউএসএ বিভিন্ন জায়গায় কাজের জন্য থাকতে হয়। বছরে একবার কলকাতায় এসে বিভিন্ন আধ্যাত্বিক বিষয়ে বক্তৃতা দেন। এবং আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এইরকম একজন জ্ঞানী মহারাজের বক্তৃতা শোনার ও আলাপ করার।
যাইহোক কাঁকুড়গাছি ‘যোগদ্যান মঠ’ যেখানে ঠাকুর রামকৃষ্ণ গেছেন, শ্রীশ্রীমা থেকেছেন এবং কলকাতার কিছু জায়গার ছবি আমায় তুলতে হবে। আমি রাজি হয়ে যাই।
সেইমতো একদিন অফিস যাওয়ার পথে যোগদ্যান মঠে পৌঁছে যাই। প্রেসিডেন্ট মহারাজের সাথে দেখা করে নিজের পরিচয় দিয়ে স্বামী চেতনানন্দ যেসব ছবি তুলতে বলেছিলেন সেগুলোর জন্য অনুমতি চাই ও সঙ্গে একজনকে দেখিয়ে অনুরোধ জানাই।
মহারাজ কোনো কথার জবাব না দিয়ে আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। প্রায় মিনিটখানেক পর উনি বললেন, “আপনি এইরকম পোষাকে ঠাকুর ও শ্রী শ্রী মায়ের ঘরে যেতে পারবেন না। আপনাকে এসব ছবি তুলতে গেলে ধুতি, গেঞ্জি বা ফতুয়া কিংবা খালি গায়ে ও তার সাথে পায়ে চটি না পড়ে তুলতে হবে।”
আমিতো অবাক হয়ে মহারাজকে বলি, ‘মহারাজ ধুতি আমার নেই। গেঞ্জি আছে। ফতুয়াও পাব। আচ্ছা ঠিক আছে দেখছি। আমি অন্যদিন ওই রকম পোশাক পরেই আসবো।’
এই বলে মহারাজকে প্রণাম করে অফিসের দিকে রওনা দিলাম। ‘ছবি তুলতে গেলে যে এই রকম পোশাক বিধি দরকার সেটা আমি জীবনে প্রথম শুনলাম’….এটাই বারবার মনে হচ্ছিলো। কিন্তু মজা লাগলো বেশ। ধুতির কথা ভাবতে গিয়েই মনে পড়ল রক্তকরবী থিয়েটার করার সময় আমায় দুটো ধুতি কিনতে হয়েছিল। ফতুয়া পরি তাই অসুবিধা হবে না।
লকডাউনের মধ্যেই কয়েকদিন পর প্রেসিডেন্ট মহারাজকে ফোন করে পোশাকবিধি মেনে কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে যোগদ্যান মঠ পৌঁছালাম। সেদিন আর মহারাজ কিছু বলেননি।
উনি একজন ব্রহ্মচারীকে আমার সঙ্গে যেতে বললেন। অনেক ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন জায়গার ছবি তুললাম। যেখানে ভক্তদেরও প্রবেশ নিষেধ আমি সেখানেও ছবি তুলেছি অবলীলায়। তবে নিজের ড্রেসের সাথে ক্যামেরা দেখে আমার খুব হাসি পাচ্ছিল।
কিন্তু যখন ওই ড্রেসে বাড়ি ফিরলাম, আমার দুই ছেলের তো আমাকে দেখে হেসে গড়িয়ে পরার অবস্থা। আমিও মজা করে বললাম, ‘ভগবানের ছবি তুলতে গেছিলাম। জিন্স প্যান্ট গেঞ্জি পরে ওসব ছবি তোলা যায় না।’
ঘটনাটা এইটুকুই। এই সূত্রেই স্বামীজী ওই বইটি আমায় পাঠিয়েছেন।
কাল থেকে বইটা বেশ কয়েকবার নাড়াচাড়া করেছি। আজ স্বামী বিবেকানন্দের প্রয়াণ দিবস। বিবেকানন্দ-রামকৃষ্ণ সম্পর্কে স্কুল জীবনেই জেনেছি। কারণ বীরভূম রামকৃষ্ণ শিক্ষাপীঠ স্কুলে নাইন অব্দি পড়েছি আমি। কিন্তু সত্যি বলতে কি, অতোদিন মহারাজদের সঙ্গে থেকে, পড়াশোনা করেও আমার কোনদিনই শুধু বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ কেন, কোন ঠাকুর সম্পর্কেই বিশ্বাস ছিল না। আজও নেই।
এমনকি ৭০ এর দশকে প্রথমদিকে নকশাল দাদাদের নির্দেশে আমি মঠের প্রেয়ার হল থেকে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ কালি সহ আরও যা যা ছিল সেইসব ছবি নিয়ে গভীর রাতে চাদরের ভেতর পুঁটুলি করে পরিত্যক্ত কুয়োয়ে ফেলে দিয়েছিলাম। এটা আমি একাই করেছিলাম। সঙ্গী বলতে টর্চলাইট আর মিশনের কুকুররা ছিল যদিও।
এটাই আমার জীবনের প্রথম বড় অপারেশন। মিশনের প্রেয়ার হলের চাবি আমার কাছেই থাকত কারণ সকালে আমি চাবি খুলে শাঁখ বাজিয়ে সকলকে আসতে বলতাম।
ওই দিন ভোরে অমল মহারাজ আমাকে নিয়ে গিয়ে সেই কুয়ো থেকে পুঁটলিটা উদ্ধার করেন। কিন্তু একবারের জন্য উনি আমায় মারধর তো দূর, বকুনি অবধি দেননি। যদিও আমি মারের ভয়ে খুব কান্নাকাটি করেছিলাম।
তবে আজও মনে পড়ে প্রেয়ার হলে বেদীর সামনে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন মহারাজ। আমরা প্রায় ২২২জন ছেলে মাথা নিচু করে বসে ছিলাম।
সেই ছোটো থেকে আজ অবধি ঈশ্বরের সাথে আমার বনিবনা নেই। বাড়িতে পূজো হলে মা আমায় থাকতে দিতো না। নাড়ু, মিষ্টি খেয়ে এঁটো করে দিতাম বলে। আপনাদের ভাষায় পুরোপুরি নাস্তিক বলা যায়। আমি ওতো জানিনা। অতোকিছু জানতেও চাই না। কিন্তু দেখেছি দিনের শেষে আস্তিক-নাস্তিক বিষয়গুলো আমায় খুব ভাবায়। এটার ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি।
আজ বিবেকানন্দের প্রয়াণ দিবসে তাঁর গুরুদেব রামকৃষ্ণের কথা মনে পড়লো। কারণ এই দুজনকে সব জায়গায় একসাথেই স্মরণ করা হয়। একজনের নাম নিলে অবধারিত অন্যজন আসেই। দুজনের চিন্তাচেতনা একই তারে বাঁধা বলেই মনে হয়। তাই আজকের দিনে সবার তরফ থেকে দুই মহামানবকে প্রণাম। আমাদের মত গরীব অবস্থা থেকেই আজ দুজন আপনাদের কাছে ঈশ্বর। আমি নাস্তিক হলেও রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের জীবনকথার সঙ্গে সেই শৈশব থেকেই পরিচিত। তাই আজ নিজের গল্পটা আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম। বইটাও মাঝে মাঝেই খুলে দেখছি।।
বিবেকানন্দ জাতধর্ম মানতেন না। শিবজ্ঞানে জীবসেবার আদর্শ দ্বারাই মানুষের মূল্যায়ন করতেন। তাঁর ধর্ম-দর্শন-অধ্যাত্মচিন্তার সবটাই জুড়ে আছে মানুষের কথা। তিনি মান আর হুঁশ নিয়ে প্রকৃত মানুষ হবার কথা বলেছেন। তাই আস্তিক হোন বা নাস্তিক জীবনের মূল ধর্মই মানুষের পাশে থাকা। আমাদের সবার সেইপথেই চলা উচিত বলে মনে করি। আপনারা ঈশ্বরকে কিভাবে বোঝেন, দেখেন আমি জানিনা, জানার দরকারও নেই। তাই আপনাদের চোখে নাস্তিক হলেও রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের জীবনআদর্শের যে মূল উদ্দেশ্য সেই লক্ষ্যেই আমি সারাজীবন মানুষের পাশে থেকেছি। তাদের অসুবিধা দূর করার চেষ্টা করেছি। ভবিষ্যতেও করবো।