দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ একের পর এক ব্যর্থতায় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে, শেষমেশ জয়েন্ট এন্ট্রান্সে ব়্যাঙ্ক না পয়ে নিজেকে শেষ করে দিতে গেছিল রাঘব। কোমায় চলে গিয়েছিল সে, জীবন থেকে মুখ ফিরিয়েছিল তার সমস্ত প্রাণশক্তি। এই সময়েই তার বাবা অনিরুদ্ধর ফ্ল্যাশব্যাকে বন্ধুদের হস্টেল জীবনের এক পরিচিত গল্প উঠে আসে। ঝরঝরে গল্প, হাসির মোড়ক, কঠিন লড়াই, অবিশ্বাস্য জয়। সবকিছুর পেছনে থেকে যায় হার না মানার পণ।
বাবার বলা এই গল্পই কোমা থেকে ফিরিয়ে আনে রাঘবকে। আলোর দিকে মুখ ফেরায়। পজিটিভ চিন্তায় বিশ্বাস করতে শেখায়। জিতে যান অনিরুদ্ধ-রূপী সুশান্ত সিং রাজপুত। সিনেমার সন্তান রাঘবকে তো বটেই, সেই সঙ্গে আরও অসংখ্য মানুষকে শিখিয়ে দেন জীবনের পাঠ। বার্তা দেন হেরে না যাওয়ার।
এটাই ছিল সুশান্ত সিং রাজপুত অভিনীত শেষ ছবি, ”ছিঁছোড়ে”র বিষয়বস্তু। এই ছবিতেই সুশান্ত দেখিয়েছিলেন, কীভাবে আত্মহত্যার প্রবণতাকে জব্দ করে মনের জোর বাড়াতে হয়। কিন্তু রবিবার সকালের দুঃসংবাদ বলছে, নিজের জীবনেই অবসাদকে জব্দ করতে পারলেন না সুশান্ত। সত্যি করে দেখাতে পারলেন না তাঁর শেষ রিলিজড ছবির চিত্রনাট্যতে তাঁর নিজের ডায়লগগুলি। রিল লাইফ থেকে অনেকটা দূরে চলে গেল রিয়্যাল লাইফ। নিজেই আত্মহননের পথ বেছে নিলেন। নতুন দিনের আলো আর ঢুকল না লকডাউনে বন্দি সুশান্তের ফ্ল্যাটে।
১৯৮৬ সালের ২১ জানুয়ারি পাটনায় এক সরকারি কর্মচারীর পরিবারে জন্মেছিলেন সুশান্ত। সুশান্তের চার দিদি আছেন। পরিবারের ছোট ছেলে সুশান্ত। সেই ছোট ছেলেই সবার আগে আজ চলে গেল। যা তাঁর পরিবারের কাছে এবং সমগ্র ভারতীয় দর্শক মহলের কাছে মর্মান্তিক।
মাত্র ১২ বছর বয়সেই মা-কে হারিয়েছিলেন সুশান্ত। ঘটনাচক্রে, তাঁর শেষ ইনস্টাগ্রাম পোস্টে রয়েছে মায়ের কথা। হয়তো অবসাদের দিনগুলিতে কুয়াশাবৃতা মাকে খুঁজতেন সুশান্ত! ২০০২ সালে সুশান্তের মাতৃবিয়োগ ঘটে। কিন্তু শোনা যায়, মায়ের মৃত্যুতে কিশোর সুশান্ত এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলেননি। হয়তো কোনও এক তীব্র কষ্টে, অভিমানে স্তব্ধ হয়ে গেছিলেন। কিন্তু তাঁর মা সবটা জুড়ে ছিল তাঁর সঙ্গে। হয়তো ভাবতেন, মা থাকলে তাঁর জীবনটা আর একটু অন্যরকম হত! ভাবতেন ছেলেকে রুপোলি পর্দার নায়ক দেখে মা কী বলতেন?
সুশান্ত খুব ছোটবেলাতেই হোস্টেলে পড়তে আসেন বাড়ি ছেড়ে। মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হতো। দু’জনেরই মন খারাপ, কেউ কাউকে বুঝতে দিতেন না। কিন্তু মায়ের চলে যাওয়া নিয়ে অনেক বড় বয়স পর্যন্তও বড় কষ্টে ছিলেন সুশান্ত।
পরে একটি সাক্ষাৎকারে সুশান্ত বলেছিলেন, “২০০২ সালের ১১ ডিসেম্বর। রাত সাড়ে ১১টায় মা ফোন করেছিল হস্টেলে। আমি তো অবাক। মা কাঁদছিল। আমি বলছিলাম, “মা আমি কী ভুল করেছি, কী হয়েছে?” মা বলেন, “কিছু হয়নি। তুমি কিছু সময় নিয়ে একবার বাড়ি ফিরে আসতে পারবে? “আমি বলেছিলাম, এখন কী করে ছুটি পাব, হোলির সময় আসব। আমি মায়ের কান্না থামাতে বলেছিলাম, আমি পরিণত হওয়ার চেষ্টা করছিলাম। আমি তখন যেতে পারিনি, পরে যাই।
মা আমায় বলেছিল, আমি যেন নিজের যত্ন নিই। এইটুকুই। আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরেই মা চলে যান, ব্রেন হেমারেজে। মা কি বুঝতে পেরেছিল কিছু? সে জন্যই আমায় ডাকছিল আগে থেকে! জানি না!”
মাকে হারালেও, সুশান্ত ছিলেন বলিউডের বীরপুরুষ। জনপ্রিয়তা, পুরস্কার, সফল ছবির ফিল্মোগ্রাফি– সবই পেয়েছিলেন বড় দ্রুত। তবু এত অবসাদ! সুশান্তর মৃত্যু প্রশ্ন তুলে দিল, স্টাররা কি আদতেই একা! হাজার হাজার কোটি কোটি ফলোয়ার থাকলেও কোন সে একাকীত্ব মানুষকে এমন করে শূন্য করে দেয়! সুশান্তের একটি পোস্ট মনে পড়ে। যেখানে তিনি একটি ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন করতে গিয়ে বলেছিলেন, পুরুষদেরও কাঁদতে হয়!
সুশান্ত পাটনার সেন্ট কারেন্স হাইস্কুল ও পরে নয়াদিল্লির কুলাচি হংসরাজ মডেল স্কুলে পড়াশোনা করেন। উচ্চমাধ্যমিকের পর সর্বভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় সর্বভারতীয় স্তরে ৭ নম্বর স্থানাধিকার করেন। এরপর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনাও শুরু করেন। সুশান্তের এক দিদি মিতু সিং একজন রাজ্যস্তরের ক্রিকেটার।
সুশান্ত দিল্লি কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করলেও, তাঁর শখ ছিল অভিনয়ের। বলিউড, ফিল্ম, মডেলিং– এসব তাঁকে ছোট থেকেই আকর্ষণ করত। তিন বছর পড়াশোনার পরে তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে অভিনয় জগতে প্রবেশ করেন। পদার্থবিদ্যার জাতীয়স্তরে অলিম্পিয়াড বিজয়ী ছেলের এমন মতিগতি তখন অনেকেই ভাল চোখে দেখেননি। শুধু তাই নয়, সুশান্ত বিমান চালাতেও জানতেন। জানতেন দারুণ নাচ, জানতেন মার্শাল আর্টস। থিয়েটারেও অভিনয় চালিয়ে যান। কিছুদিন নাদিরা বব্বরের দল “একজুটে”র সদস্য ছিলেন। তিনি নাট্যপরিচালক ব্যারি জনের নাটকের ক্লাসেও ভর্তি হয়েছিলেন।
২০০৯ সালে ‘পবিত্র রিস্তা’ ধারাবাহিকে মানব দেশমুখের চরিত্রে অভিনয় করে বড় ব্রেক পান সুশান্ত। ২০১০ সালে তিনি ড্যান্স রিয়েলিটি শো ‘ঝলক দিখলা জা ২’-এ মস্ত কলন্দর বয়েজ টিমে অংশগ্রহণ করেন। সুশান্তের প্রতিটি ড্যান্স পারফরমেন্স টেলিভিশন টিআরপি বাড়াতে থাকে। “মোস্ট কনসিস্টেন্ট পারফর্মার” পুরস্কারও পান ওই শোয়ে। ২০১১ সালে তিনি পবিত্র রিস্তা ধারাবাহিকের কাজ ছেড়ে দেন চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে।
এর পরে ২০১৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় অভিষেক কাপুর পরিচালিত ‘কই পো চে’। এটিই রাজপুতের প্রথম ডেবিউ ছবি, দারুণ সফল ছবি। শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কারও পান সুশান্ত। এর পরে আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
মনীষ শর্মা পরিচালিত ‘শুদ্ধ দেশি রোম্যান্স’ ছবিতে পরিণীতি চোপড়া ও বাণী কাপুরের বিপরীতে অভিনয় করেন। এই ছবিটিও বাণিজ্যিক ভাবে সফল হয়। সুশান্ত-পরিণীতি জুটির গান ‘তেরি মেরি বিচ মে’ এবং ‘গুলাবি’ প্রেমের বসন্তের গোলাপী হাওয়া ছড়িয়ে দেয় সমগ্র ভারতে। এই ছবির গান সুপারহিট হবার পর এবং সুশান্ত রীতিমতো মেয়েদের হার্টথ্রব হয়ে ওঠেন। সোশ্যাল মিডিয়া ছেয়ে যায় প্রশংসায়।
রাজকুমার হিরানি পরিচালিত পিকে চলচ্চিত্রে রাজপুত একটি ছোট চরিত্রেও অভিনয় করেন সুশান্ত। সেখানেও জনপ্রিয় হয় সুশান্তের গান অনুস্কা শর্মার সঙ্গে ‘চার কদম’। সুশান্ত মানেই হয়ে দাঁড়ায় নিউ এজ রোম্যান্টিক হিরো।
এর পরে সুশান্ত যখন দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বকসী’ ছবিতে বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত গোয়েন্দা রচিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন, তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয় ফিল্ম মহলে। এই ছবিতে সুশান্তের সঙ্গে অভিনয় করেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়।
এর পরে ‘এম এস ধোনি, আ আনটোল্ড স্টোরি’ তাঁর কেরিয়ারের বড় হিট। ধোনির মুখ্য ভূমিকায় তিনি অভিনয় করে বক্সঅফিস হিট দেন। ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে মনোনয়নও পান। এর পরে একে একে আসে রাবতা, কেদারনাথ, ছিঁছোড়ে, ড্রাইভ। কেদারনাথ ছিল সুশান্তের শেষ সফল ছবি। সারা আলি খান অভিনয় করেন সুশান্তের বিপরীতে।
প্রথমে ব্যাকগ্রাউন্ড ডান্সার, তারপর টেলিভিশন আর এখন চলচ্চিত্রের দক্ষ অভিনেতা নায়ক। সুশান্তের পথটা মোটেই সহজ ছিলনা। গড ফাদার ছাড়াও যে এগিয়ে যাওয়া যায় বলিউডে, তাই প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন সুশান্ত।
তবে শোনা যায়, কেরিয়ার খুব ভাল ভাবে এগোলেও ব্যক্তিগত জীবনে খুব একটা সুখী ছিলেন না সুশান্ত। অঙ্কিতা লোখণ্ডের সঙ্গে দীর্ঘদিন সম্পর্কে থাকার পরে কৃতী শ্যাননের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান সুশান্ত। তার পরে আর এক অভিনেত্রী রিয়া চক্রবর্তীর সঙ্গেও নাম জড়ায় তাঁর। এ খবর কারও অজানা নয়। এ বছর জানুয়ারিতে সুশান্তের জন্মদিনে ভালবাসায় মাখা শুভেচ্ছাবার্তা দিয়ে প্রেমের খবরে কার্যত স্ট্যাম্প দিয়েই দিয়েছিলেন রিয়া। সুশান্তের সঙ্গে দুটো রোম্যান্টিক ছবি পোস্ট করে রীহা লিখেছিলেন, ‘শুভ জন্মদিন মানব সভ্যতার সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে বিশাল ব্ল্যাক হোল। এ ভাবেই এগিয়ে যাও সুশান্ত। সোনা দিয়ে মোড়া তোমার মন।”
তখন অবশ্য রিয়া সংবাদমাধ্যমকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, সুশান্তের সঙ্গে তাঁর কেবলমাত্র বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
সাম্প্রতিক এই লকডাউনে এতগুলো দিন ধরে বাড়িতে একাই ছিলেন সুশান্ত। রবিবার সকালে পুলিশ মুম্বইয়ের বাড়ি থেকে সুশান্তের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করেছেন। তাঁর বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তাঁর লেখা কিছু বিষণ্ণ চিঠি ও কাগজ। যা পড়ে স্পষ্ট হয়েছে, সুশান্ত মানসিক অবসাদে দিন কাটচ্ছিলেন শেষ কিছুদিন। তার উপর কয়েক দিন আগেই, সুশান্তের প্রাক্তন মহিলা ম্যানেজার কাম পিআর দিশাও সুইসাইড করেন।
পরপর দুই সুইসাইড রহস্য ঘনীভূত করেছে স্বাভাবিক ভাবেই। যোগসূত্র খুঁজছেন সকলেই। কিন্তু মৃত্যু বোধহয় কেবল বিয়োগান্তক হিসেবই মেলাতে পারে। বাকি সবকিছু সেখানে তুচ্ছ। তাই শত উজ্জ্বল সাফল্যের আড়ালেও কোন এমন অন্ধকার ঘনিয়ে উঠেছিল যার জন্য নিজেকে শেষ করে দিলেন অভিনেতা, সে উত্তর এখন সময়ের অপেক্ষা।