ঠাকুর বাড়ির রান্নাঘর
ঠাকুর বাড়ির মহিলাদের নিয়ে এখনোও অনেক কৌতূহল আমাদের মনে রয়ে গেছে| বাংলার নারী জাগরণের কথা ভাবলে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মহিলারা এক অন্যতম ভূমিকা পালন করে এসেছেন৷
একক অথবা সম্মিলিত উভয়ভাবেই তাঁরা এসেছেন অন্ধকারের প্রজ্বলিত প্রদীপের আলো হয়ে; তাদের সম্পর্কে অনেক তথ্য আজও আমাদের অজানা রয়ে গেছে| শিল্প শিক্ষা সংস্কৃতি সকল ক্ষেত্রেই তাঁদের ভূমিকা যেমন আলোচ্য তেমনি আলোচ্য তাঁদের অন্দরমহলের রান্নাঘরও| এ প্রসঙ্গে কাদম্বরী, মৃণালিনী, শরৎকুমারী, সরোজ সুন্দরীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হেমেন্দ্রনাথের মেজো মেয়ে প্রজ্ঞা সুন্দরী দেবী|
সৌদামিনীদের প্রতিদিনই যেমন একটি করে তরকারি রাঁধা শিখতে হতো, প্রজ্ঞা সুন্দরী যেন রান্না শিখেছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রেই, শোনা যায় প্রজ্ঞার মা নৃপময়ী ভালো রাঁধতে পারতেন| এবিষয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথেরও বিশেষ উৎসাহ ছিল, মহর্ষি মিষ্টি তরকারি পছন্দ করতেন; রান্নায় মিষ্টি দেওয়ার প্রচলন শুরু হয় এই ঠাকুরবাড়ি থেকেই|
প্রজ্ঞা সুন্দরী শুধু যে ভালো রাঁধতেন তাই নয়, সেই যুগে রন্ধন তত্ব ও রন্ধন বিদ্যায় নিজেকে একপ্রকার পারদর্শী করে তুলেছিলেন নিয়মিত পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে রন্ধন সংক্রান্ত আবিষ্কারের মাধ্যমে| যা তিনি লিপিবদ্ধও করে রাখতেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য| হেন্দ্রনাথের পুত্রকন্যা তথা প্রজ্ঞার ভাইবোনদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই প্রকাশিত হতো তৎকালীন ‘পুণ্য’ পত্রিকা আর এর প্রথম সম্পাদিকা ছিলেন প্রজ্ঞাসুন্দরী নিজেই|
প্রথম থেকেই আমিষ ও নিরামিষ রান্নার ভিন্ন পদ্ধতি ছাপা হতে থাকে এই পত্রিকায়, সেইসাথে তৎকালীন বাজারদরটিও প্রজ্ঞা জানাতে ভুলতেন না তার পাঠিকাদের| বিলাতি ভোজসভার মেনু কার্ডের মতন প্রজ্ঞা স্থির করেন তিনিও নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের জন্য ক্রমণীর ব্যবস্থা করবেন; ছাপা ক্রমণী যদি হাতে হাতে বিলি করা নাও যায়, তাহলে তা সুন্দর করে লিখে দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিলেই চলবে|
ভোজে কি কি পদ থাকবে, কোন পদের পরে কোনটা আসবে কিংবা কেমন করে লিখলে তা শিল্পসম্মত হয়ে উঠবে সে কোথাও তিনি ভেবেছেন| প্রজ্ঞা প্রচলন করলেন বাংলা মেনু কার্ড অথবা নিজ ভাষায় ‘ক্রমণী‘| প্রজ্ঞার ক্রমণীতে থাকতো ফরাসি কায়দায় ইচ্ছা নির্বাচনের সুযোগও তাই বোধহয় তার ক্রমণীও হতো বেশ দীর্ঘ|
কাকা রবীন্দ্রনাথ ভাইজির এই রন্ধন নৈপুণ্যে ছিলেন নিশ্চই বেজায় খুশি, রান্না এবং নতুন খাদ্যদ্রব্য সন্মন্ধে তাঁর উৎসাহও যে কম ছিল না, বহু মহিলাই তাঁদের স্মৃতিকথায় সেকথা বলে গেছেন|
হেমেন্দ্রনাথের মেজো মেয়ে এই প্রজ্ঞা সুন্দরীর বিবাহ স্থির হয় অসমীয়া সাহিত্যের জনক তৎকালীন ছাত্র লক্ষীনাথ বেজবড়ুয়ার সাথে| শোনা যায় লক্ষীনাথ প্রজ্ঞার ছবি দেখেই মুগ্ধ হয়ে বিয়েতে রাজি হয়ে যান|
স্বামী খেতে ভালোবাসতেন, আর লেখা আর রচনা ছিল বাড়ির রেওয়াজ, তাই প্রজ্ঞা বিভিন্ন রান্নার পদ সৃষ্টি করেছেন, প্রতিটি পদ পরীক্ষা করেছেন স্বামীকে খাইয়ে এবং তা ডাইরিতে লিখে রেখেছেন| পরবর্তীকালে স্বামীর অনুপ্রেরণায় প্রজ্ঞা বের করেন তার এই রন্ধনশৈলীর কয়েকটি বই আজ দুষ্প্রাপ্য বলা চলে|
এই কবিপক্ষের সময় তাই এখানে উল্লেখ করা হলো প্রজ্ঞার সৃষ্ট ঠাকুরবাড়ির কয়েকটি রান্নার পদ|
করলার শুক্তানি
উপকরণ: ১ টি বড় মাপের করলা, ৭টি আলু, কচি সজনেডাঁটা দশ গাছি, ৪টি পটল, বেগুন ১২৫ গ্রাম, ১টি কাঁচকলা, ৭টি বড়ি, ভিজে ছোলা একমুঠো, তেজপাতা ২টো, আদা ১২গ্রাম, সরষে বড় চামচের হাফ চামচ, হলুদ আড়াই চা চামচ, ধনে ২চা চামচ, রাঁধুনি আড়াই চা চামচ, দুধ ২ বড় চামচ, চিনি১ চা চামচ, নুন দেড় চা চামচ, তেল ৩ বড় চামচ, জল সাড়েচার কাপ|
প্রণালী : সমস্ত সবজি ছোট টুকরো করে কেটে নিতে হবে| আদা বেটে নিতে হবে|
কড়াইতে তেল দিয়ে বড়ি ভেজে নিতে হবে| বেগুন হালকা ভেজে তুলে নিতে হবে| এরপর করলা হালকা ভাজা হলে আলু দিতে হবে, এইসময় হলুদ, ধনে ও সরষে জলে গুলি ঢেলে দিতে হবে, ফুটে উঠলে বেগুন, কাঁচকলা, সজিনা ডাঁটা, নুন ও ছোলা দিতে হবে| প্রায় মিনিট পনেরো পরে সব তরকারি সেদ্ধ হলে নামাতে হবে|
আবার কড়াইতে বাকি তেল টুকু দিয়ে তেজপাতা, সরষে ও রাঁধুনি ফোড়ন দিয়ে এর মধ্যে নামিয়ে রাখা তরকারি ঢেলে সম্বর দিতে হবে| দুধে রাঁধুনি ও চিনি গুলে এতে ঢেলে দিতে হবে| ৩-৪ ফুট হলে আদা বাটা দিয়ে কিছুক্ষন নেড়ে নামিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে|
রুই মাছের বাটি চচ্চড়ি
উপকরণ : রুইমাছ ২৫০ গ্রাম, তেল ৩ বড় চামচ, পাঁচফোড়ন১চামচ, কাঁচা লঙ্কা ৩ টি, তেজপাতা ২টি, নুন ১চা চামচ, সরষেবাটা ১চা চামচ, শুকনো লঙ্কা বাটা ২টো, হলুদ হাফ চামচ, জল২ বড় চামচ|
প্রণালী: মাছ ৬–৮ পিস্ করে কেটে ধুয়ে নিতে হবে| কড়াইতেতেল দিয়ে মাছ ভেজে নিতে হবে| এরপর পিতল অথবা কলাইকরা বাটিতে বাকি রাখা তেল দিয়ে তার ওপর মাছ, সব রকমমশলা, কাঁচা লঙ্কা কুচানো, নুন, তেজপাতা, পাঁচফোড়ন, জলসব দিয়ে ভালো করে নেড়ে মাছের সাথে মশলা মাখিয়ে বাটিরমুখ ঢেকে দিতে হবে; এরপর তাকে হালকা নরম আঁচে বসিয়েরাখতে হবে| ১৫–২০ মিনিট পর ভালো করে ফুটে তেল ভেসেউঠলে নামাতে হবে|
লাউডাঁটা ও চিংড়ির ছেঁচকি
উপকরণ: লাউ ডাঁটা এক ডাল, শুকনো লঙ্কা ২টো, কুচোচিংড়ি ৬০ গ্রাম, পাঁচ ফোড়ন ১ চা চামচ, নুন ১ চা চামচ, সাদাসরষে বাটা দেড় বড় চামচ, তেল ৩ বড় চামচ|
প্রণালী: লাউডাঁটা ১ আঙ্গুল লম্বা করে কেটে আঁশ ছাড়িয়েনিতে হবে| কুঁচো চিংড়ি ভালো করে ছাড়িয়ে ধুয়ে নিতে হবে| এরপর চিংড়ি মাছ ভালো ভাবে ভেজে আলাদা তুলে নিতেহবে, বাকি তেলে লঙ্কা, পাঁচফোড়ন দিয়ে, লাউডাঁটা দিয়েভেজে নুন ও ৩ বড় চামচ জল দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে| লাউডাঁটা সিদ্ধ হলে সরষে বাটা জলে গুলে এতে ঢেলে দিতেহবে, এরপর চিংড়ি মাছ দিয়ে নেড়ে ভালো করে ফুটে উঠলেনামাতে হবে|
পুইঁ ডাঁটা ও চিংড়ি মাছের চচ্চড়ি
উপকরণ: পুইঁ ডাঁটা এক ডাল, শুকনো লঙ্কা ২টো, কুচো চিংড়ি৬০ গ্রাম, ১কোয়া রসুন, নুন ১ চা চামচ, সাদা সরষে বাটা দেড়বড় চামচ, তেল ৩ বড় চামচ|
প্রণালী: তেলে ডাঁটা ও মাছ ভেজে নিতে হবে| হলুদ, লঙ্কা ওসরষে বাটা দিয়ে ভালো করে ভাজতে হবে, এরপর সিদ্ধহওয়ার মতন জল দিয়ে ঢাকা দিতে হবে| ডাঁটা ও মাছ সিদ্ধহয়ে জল শুকিয়ে এলে অন্য একটি পাত্রে তেল গরম করেরসুন ফোড়ন দিয়ে তরকারি সাঁতলে নিতে হবে|
আনারস দিয়ে মুগের ডাল
উপকরণ: আনারস সিকিখানা, মুগের ডাল ১২৫ গ্রাম, জলসাড়ে চার কাপ, হলুদ ২ বড় চামচ, লেবু ২টি, শুকনো লঙ্কা ১টি, নুন ১ চা চামচ, চিনি ১ চামচ, কাঁচা লঙ্কা ২টি, তেজপাতা১টি, সরষে হাফ চা চামচ |
প্রণালী:
হলুদ ও লঙ্কা বাটা দিয়ে ডাল সিদ্ধ করতে দিতে হবে,
ডাল সিদ্ধ হয়ে গেলে কাটা দিয়ে ,
তাতে আনারস টুকরো,
নুনও চিনি দিয়ে নেড়ে নামাতে হবে|
এরপর কড়াইতে ঘি গরমকরে তেজপাতা,
কাঁচালঙ্কা কুচি,
সরষে ফোড়ন দিয়ে নামিয়েরাখা ডাল সাঁতলে নিতে হবে|
নামানোর আগে লেবুর রস দিয়েভালো করে নেড়ে নিতে হবে|
ক্রমশ: