দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ নতুন শিক্ষানীতি নিয়ে সর্বত্র চলছে আলোচনা। সমস্ত মহলেই নানা রকম মতামত। একটা কথা স্পষ্ট, নয়া শিক্ষানীতির যে প্রস্তাব কেন্দ্রীয় সরকার এনেছে, তাতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক– এই তিনটি স্তরেই আমূল বদল ঘটতে চলেছে। এই বদলের পক্ষে বা বিপক্ষে অনেক রকম বিতর্কও উঠছে। এখন প্রশ্ন হল, ঠিক কী কী বদল আসছে এই নয়া নীতিতে। পড়ুয়াদের উপর এর প্রভাবই বা কী পড়বে।

দেশের সামগ্রিক শিক্ষার মান আরও উন্নত করার জন্য এই নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতির প্রস্তাব রেখেছেন বিশেষজ্ঞরা। ১৯৬৪ সালে প্রথম এ নীতির কথা ভাবা হয়েছিল। কংগ্রেস সাংসদ সিদ্ধেশ্বর প্রসাদ অভিযোগ করেছিলেন, সরকারের যে শিক্ষানীতি তাতে চিন্তনের অভাব রয়েছে। সেই বছরেই ১৭ সদস্যের একটি এডুকেশন কমিশন গড়া হয়। কমিশনের মাথায় ছিলেন ইউজিসি-র তৎকালীন প্রধান ডিএস কোঠারি। সেই কমিশনই ১৯৬৮ সালে একটি নয়া শিক্ষানীতির প্রস্তাব এনেছিল, যা পার্লামেন্টে পাশও হয়েছিল।

সাধারণত কয়েক দশক ছাড়াই নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি আসার কথা। ভারতে ১৯৬৮ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে নতুন শিক্ষানীতি আসার পরে ১৯৮৬-তে ফের নতুন শিক্ষানীতি এনেছিলেন রাজীব গান্ধী। এই নীতি ফের নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়েছিল ১৯৯২ সালে, যখন নরসিংহ রাও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এর পরে তৃতীয় দফায় নতুন শিক্ষানীতির প্রস্তা এল বুধবার, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই শেষতম যে শিক্ষানীতি এসেছে, তাতে এদেশের পড়ুয়াদের বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পৌঁছনো সহজ হবে। কারণ পুরনো শিক্ষাকাঠামোর খোলনলচে বদলে স্নাতক স্তরের আগে চার বছরের মাল্টিডিসিপ্লিনারি কোর্স পড়ার ফলে বিষয় নির্বাচনের বিকল্প আরও বাড়বে পড়ুয়াদের। স্কুলস্তরের পড়াশোনায় বোর্ডের পরীক্ষা আরও সহজ হবে। সিলেবাসের আয়তন কমিয়ে সুনির্দিষ্ট জরুরি বিষয়ে ধারণা আরও পোক্ত করার দিকে জোর দেওয়া হবে। পরীক্ষামূলক শিক্ষায় ও নানারকম নতুন চিন্তার জায়গা উন্মুক্ত করার দিকে নজর রাখা হবে।

শেষতম শিক্ষানীতি অনুযায়ী যেখানে ১০+২ হিসেবে স্কুলশিক্ষা চলত, সেটাই নয়া শিক্ষানীতির প্রস্তাবে বদলে যাবে ৫+৩+৩+৪ এরকম কাঠোমোয়। তিন থেকে ৮ বছর পর্যন্ত বাচ্চারা পড়বে প্রথম পাঁচ বছর। সেটা তাদের ভিত গড়ার কাজে লাগবে। ফাউন্জেশন স্টেজ। এর পরে ৮ থেকে ১১ তিন বছর থাকবে প্রিপেরাটরি স্টেজ। অর্থাৎ আসল পড়াশোনার জগতে ঢোকার প্রস্তুতি। এর পরে ১১ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত আরও ৩ বছর চলবে মিডল স্টেজ। শেষে ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত, শেষ চার বছর হল সেকেন্ডারি, অর্থাৎ স্কুল জীবনের শেষ পর্ব।

এখন বাচ্চারা যে ৫ বা ৬ বছর বয়সে ক্লাস ওয়ান থেকে পড়াশোনা শুরু করে, তার আগে দু-তিন বছর প্রায় ক্ষেত্রেই প্রি-স্কুলিং চলে, যা স্কুলগুলি নিজের মতো করে তৈরি করে। কিন্তু নয়া শিক্ষানীতিতে গোড়া থেকেই সবটা আসবে সরকারি শিক্ষার অন্দরে। এমনকি এই বাচ্চাদের মিড ডে মিলও দেওয়া হবে। গোড়া থেকে ক্লাস ৫ পর্যন্ত প্রতিটি শিশু তার আঞ্চলিক মাতৃভাষাতেই পড়াশোনা করবে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলির ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য হবে।

প্রশ্ন উঠেছে, কোনও বাচ্চাকে যদি পারিবারিক কারণে রাজ্য বদলাতে হয়, অথবা তার বাবা এবং মায়ের নিজস্ব ভাষা যদি আলাদা হয়, তাহলে সে প্রথম কয়েক বছর কোন ভাষায় পড়াশোনা করবে? এবিষয়ে অবশ্য নতুন পলিসিতে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। তবে উল্লেখ করা আছে, কোনও বাচ্চার বাবা ও মা দু’রকম ভাষার হলে, শিক্ষকদেরও চেষ্টা করতে হবে দু’রকম ভাষাই যেন বাচ্চা শেখে।

তবে এই পদ্ধতি এখুনি যে শুরু করে দিতে হবে, বা চাইলেই যে শুরু করে দেওয়া যাবে, তা নয়। বদল করতে হবে ধাপে ধাপে, এ বদল করতে সময়ও লাগবে। এখনই সমস্ত বোর্ডকে তাদের কাঠামো বদলে ফেলতে হবে না বাধ্যতামূলক ভাবে। প্রতিটি রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা যখন মনে করবে কেন্দ্রের এই শিক্ষানীতি প্রয়োগ করতে পারার মতো প্রস্তুতি রয়েছে তাদের, তখনই তা হবে। মোটামুটি ২০৪০ সালের মধ্যে দেশজুড়ে এই নীতি চালু হতে পারে। এ জন্য পর্যাপ্ত ফান্ডিংও জরুরি।

সরকার ঠিক করেছে, প্রতিটি সাবজেক্ট-অনুযায়ী একটি করে বিশেষ কমিটি তৈরি করা হবে। সেই কমিটিতে মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক, শিক্ষা দফতর, স্কুল বোর্ড– ইত্যাদি সমস্ত উঁচুতলার প্রতিনিধিরা থাকবেন। সর্বতো আলোচনা করে সে কমিটি ঠিক করবে, প্রতি বছর কতটা করে এগোনো যায় নয়া শিক্ষানীতির দিকে।
দাবি করা হয়েছে, বিশ্বের ১০০টি শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় এ দেশে ক্যাম্পাস গড়ার মতো পরিকাঠামো গড়ে উঠবে নয়া শিক্ষানীতিতে। তবে এটা কতটা সম্ভব হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ এর আগেও ২০১৩ সালে এমনই একটি বিল পাশ হয়েছিল পার্লামেন্টে। কিন্তু একটি রিপোর্ট বলছে, কেমব্রিজ, স্ট্যান্ডফোর্ড-সহ অন্তত ২০টি গ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয় এ দেশের বাজারে নিজেদের ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করতে অনীহা দেখিয়েছিল।
নয়া শিক্ষানীতিতে যে শেষ চার বছরের সেকেন্ডারি কোর্স রয়েছে, সেখানে পড়ুয়ারা বেশ কিছু রিসার্চ ওয়ার্ক করার সুযোগ পাবে। প্রতিটি বিষয়ে আরও গভীর ও ব্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হবে। এই পড়াটা এতই গভীর ও সুনির্দিষ্ট হবে, যে স্নাতক স্তরে পড়ুয়ারা রিসার্চ প্রোগ্রাম শুরু করতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে। চার বছরের ধারাবাহিক রেজাল্ট দেখে এই সুযোগ পাওয়া যাবে।
এর ফলে মাস্টার্স শেষ করার পরে সরাসরি গবেষণার কাজ করা অর্থাৎ পিএইচডি শুরু করা অনেক সহজ হবে। পড়ুয়াদের প্রস্তুতি অনেকটাই এগিয়ে থাকবে। মাস্টার্স করার পরে পিএইচডি শুরু করার আগে যে এম.ফিল করতে হয় অনেক ক্ষেত্রে, তার আর প্রয়োজন থাকবে না। সারা বিশ্বেই এই এম.ফিলের ধাপটি বাদ পড়ছে ধীরে ধীরে।
চার বছর ধরে এই মাল্টি ডিসিপ্লিন পড়াশোনার ফলে কি পড়ুয়ার কোনও বিশেষ বিষয়ের প্রতি একমুখী একাগ্রতায় ব্যাঘাত ঘটবে না? এই প্রশ্নও তুলেছেন অনেকেই। কিন্তু এই একমুখী পড়াশোনার ধারা ইতিমধ্যেই ভাঙতে শুরু করেছে। আদর্শ শিক্ষানীতিতে তেমনটাই হওয়ার কথা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন আইআইটি দিল্লি অত্মধ্যেই হিউম্যানিটিজ় বিভাগ চালু করেছে। আইআইটি খড়্গপুরেও রয়েছে মেডিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগ।
এ বিষয়ে একটি উপযুক্ত উদাহরণ দিয়েছেন আইআইটি দিল্লির ডিরেক্টর ভি রামগোপাল রাও। তাঁর কথায়, “আমেরিকার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও এখন মাল্টিডিসিপ্লিনে জোর দিচ্ছে। যেমন এমআইটি-তে হিউম্যানিটিজ় বিভাগ চলছে হৈহৈ করে। এর কারণও রয়েছে ধরা যাক, কোনও এক জন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার একটি বাঁধ বানাবেন কোনও এলাকায়। এ ক্ষেত্রে কিন্তু তিনি শুধুই নকশা আর অঙ্কে তুখোড় হলে চলবে না। তাঁকে বাঁধ নির্মাণের এলাকার পরিবেশ ও সমাজ সম্পর্কেও বুঝতে হবে। অনেক ইঞ্জিনিয়ার তো নিজেদের ফার্মও গড়েন। সেক্ষেত্রেও তাঁরা যদি অল্প ইকোনমিক্স জেনে থাকেন, তা তাদের কাজকেই এগিয়ে দেবে।”
