

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী তথা আওয়ামী লিগ নেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চলমান মামলায় আজ সোমবার রায় ঘোষণা করবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল। ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বেঞ্চ রায় ঘোষণা শুরু করবেন। রায় ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া দেবেন শেখ হাসিনা।

রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে অশান্তির আশঙ্কায় গোটা বাংলাদেশে রবিবার সকাল থেকেই রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। সেনা ও পুলিশের ছয়লাব করে দেওয়া হয়েছে গলি থেকে রাজপথ। সচিবালয়, সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল সহ একাধিক জায়গায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে উপদেষ্টাদের অফিস ও বাড়ির।
রবিবার রাতে ঢাকার সেন্ট্রাল রোড এলাকায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের বাড়ির সামনে দুটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তাতে কেউ হতাহত হননি। ঢাকার বাংলা মোটর এলাকায় জাতীয় নাগরিক পার্টির অফিসের সামনেও রবিবার রাতে ককটেল বিস্ফোরণ হয়। সেখানেও কেউ হতাহত হননি। তবে আতঙ্ক ছড়িয়েছে ঢাকা সহ গোটা দেশে।
এই প্রথম কোন মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজার মুখে পড়তে চলেছেন আওয়ামী লিগ সভানেত্রী। কত মাসে এই মামলার শুনানি শেষে রাষ্ট্রপক্ষ তথা মহম্মদ ইউনুস সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছে।

মানবতাবিরোধী পাঁচটি অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগে দায়ের হওয়া এই মামলায় অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও বাংলাদেশ পুলিশের প্রাক্তন প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি এই মামলায় রাজসাক্ষী হয়েছেন।
আদালতে তাঁর বক্তব্য শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থানকে জোরদার করেছে বলে ওয়াকিবহাল মহলের দাবি। গতবছর জুলাই অগস্টের আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহারে হবে প্রধানমন্ত্রী ও প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে আদালতে দাবি করেছেন এই প্রাক্তন পুলিশ কর্তা। রাজসাক্ষী হওয়ায় তাঁর সাজার পরিমাণ কম হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। সরকারপক্ষ তাঁর কঠোর সাজা দাবি করেনি।
শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালেরও মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছে সরকার পক্ষ। বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ফাঁসি অথবা ফায়ারিং ওয়ার্ডে গুলি করে হত্যার মধ্য দিয়ে। মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি হাসিনা ও কামালের যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আরজিও সরকারপক্ষ জানিয়েছে ট্রাইবুনালের কাছে।

শেখ হাসিনা তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের মতই রাজনৈতিক জীবনে একাধিকবার জেলে গিয়েছেন। তবে কোন মামলাতেই তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজার মুখোমুখি হননি। বিচারাধীন আসামি হিসাবে কারাগারে কাটিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আদালত অবমাননার একটি মামলায় তাঁর নাম জড়িয়ে ছিল। সেই মামলায় আদালত প্রকাশ্যে তাঁর বিরুদ্ধে কোন সাজা ঘোষণা করেনি। হাসিনার আইনজীবীকে আদালতের বক্তব্য লিখিতভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে জানা যায় আদালতের তরফে তাকেঊ সতর্কতার সঙ্গে মন্তব্য করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
ট্রাইবুনালের মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সাজা ঘোষণা করা হবে ধরে নিয়ে আওয়ামী লিগ রবি ও সোমবার বাংলাদেশের শাটডাউনের ডাক দিয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের বিচার সংক্রান্ত সংস্থার কাছে শেখ হাসিনার তরফে হস্তক্ষেপ দাবি করা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ট্রাইবুনালে বিচার সম্পূর্ণ বেআইনি। তার অনুপস্থিতিতে শুনানি করে সাজা ঘোষণা সিদ্ধান্ত হয়েছে।
হাসিনার বিরুদ্ধে যে পাঁচটি অভিযোগ সরকার পক্ষ করেছে সেগুলি হল –

১). ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা ও নাতিপুতি’ হিসেবে আখ্যা দেন। এরপর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচণা ও নির্দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং সশস্ত্র আওয়ামী লিগ নেতা, কর্মী, সমর্থকরা নিরীহ, নিরস্ত্র ছাত্র–জনতার ওপর আক্রমণ চালায়।
২). হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের হত্যা ও নির্মূলের নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। এভাবে হত্যা করা হয় হাজারেরও বেশি আন্দোলনকারীকে। পলাতক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও গ্রেপ্তার সাবেক আইজিপি অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ, সহায়তা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
৩). রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডে সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ তিনজনের বিরুদ্ধে প্ররোচনা, উসকানি ও সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনা হয়েছে।
৪). গত বছরের ৫ অগস্ট ঢাকার চাঁনখারপুলে ছয়জনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি করে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছেন হাসিনা ও অন্য আসামীরা আসামিরা।
পাঁচ. ঢাকার আশুলিয়ায় গুলি করে হত্যা করা পাঁচ আন্দোলনকারীর মরদেহ এবং জীবিত একজনকে পুলিশ ভ্যানে পুড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী।

এর আগে গত ১৩ নভেম্বর ট্রাইবুনাল জানিয়েছিল শেখ হাসিনার মামলায় সাজা ঘোষণা করা হবে ১৭ নভেম্বর সোমবার। ১৩ তারিখ আওয়ামী লিগের ডাকে ঢাকায় লকডাউন এর কর্মসূচি পালিত হয়। দলের দাবি, শেষ পর্যন্ত শুধু রাজধানী নয়, বাংলাদেশের কমবেশি সব জেলাতেই লকডাউনের পক্ষে মানুষের সাড়া পাওয়া গিয়েছে। বহু মানুষ সেদিন স্বেচ্ছায় বাড়ি থেকে বের হননি।
আওয়ামী লিগ আশা করছে সোমবার হাসিনা সাজা ঘোষণার দিনে দেশের মানুষ বাড়ি থেকে বের হবেন না। দেশ অচল করার সংকল্প নিয়ে কোমর বেঁধে প্রস্তুতি নিয়েছে শেখ হাসিনার দল। দলের তরফে এক প্রবীণ নেতা বলেন সোমবার ঢাকার থেকেও জেলাগুলিতে শাটডাউন অনেক বেশি সফল হবে। তাঁর বক্তব্য রাজধানী সচল রাখতে ইউনুস সরকার সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে রীতিমতো হুঁশিয়ারি দিয়েছে যাতে কর্মীরা অফিসে আসেন। ১৩ নভেম্বর বেশ কিছু বেসরকারি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রেখে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করেছিল। তাদেরও প্রশাসনের তরফে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে কোন অবস্থাতেই শিক্ষাঙ্গন বন্ধ রাখা বন্ধ রাখা যাবে না।

দেশ সচল করতে সক্রিয় মহম্মদ ইউনুসের প্রশাসন রবিবার থেকে ঢাকা সহ বিভিন্ন শহরের গলি থেকে রাজপথের দখল নিয়েছে সেনা ও পুলিশ। সঙ্গে আছে বিজিবি আনসার ও র্যাব।
১৩ নভেম্বর লকডাউনের দিন আওয়ামী লিগের মোকাবিলায় পথে নেমেছিল বিএনপি এবং জামাত। জামাতি ইসলামিসহ ৮ দলের জোট রবিবার ঢাকায় সাংবাদিক বৈঠক করে ঘোষণা করেছে, সোমবার তারা রাজপথে সক্রিয় থেকে আওয়ামী লিগের শাটডাউন বানচাল করে দেবে।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার আট দলের যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে এ কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা অতীতের কর্মসূচিতেও মাঠে ছিলাম, এবারও ফ্যাসিবাদের পক্ষে নাশকতার কোনো সুযোগ জাতি দেবে না। তারা (আওয়ামী লিগ) এটার সুযোগ পাবে না। আমরা আটদল মাঠে থাকব।



