রজত বিশ্বাস: কাল পর্যন্ত অনামি অখ্যাত ছিল নাম টা। আর পাঁচটা অতি সাধারণ গরীব নুন আনতে পান্তা ফুরোনো পরিবারের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাওয়া কোনো এক মেয়ে। অদম্য জেদ, চেষ্টা ইচ্ছে শক্তি তাকে এনে দিল ফ্লাশ লাইটের সামনে। সে প্রমাণ করলো যোগ্যতা তৈরি করে নিতে হয়। তার জীবনের গল্পটা সিনেমার গল্পকে হার মানায়।
জীবনের প্রতিটা সকাল তার শুরু হতো একই ভাবে সূর্যোদয়ের আগেই। কারণ সূর্যদেবের ঘুম আগে ভেঙে গেলে সে সারা দিনে পিছিয়ে পরবে। তাই সে যখন এঁটো বাসন আর জলের বালতি নিয়ে পৌরসভার জলের কল দখলে ছোটে তখন হাটখোলা আম্মেদকর পল্লীর আকাশে অন্ধকারের সামিয়ানা। সেই ভোররাতে শুরু তার রোজনামচা জীবন যুদ্ধ। শৈশবেই শেওলা ধরা স্যতস্যেতে কলতলায় শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় দিনের শুরু। ভ্যান রিক্সা চালক বাবা দশ বছর শয্যাশায়ী দুরারোগ্য ব্যাধিতে। মা এলাকায় পরিচারিকার কাজ করেন স্বামী দুই ছেলে ও এক মেয়ে সহ পাঁচ জনের সংসার চালাতে। এই সাংগ্রাম করেই কেটে গিয়েছে টুকুর শৈশব থেকে কৈশোর। আজ সে অষ্টাদশী।
এই কঠিন জীবন সংগ্রামের পরেও তার মতো মেয়েরা হয়তো পড়াশুনার কথা ভাবতেই পারতোনা, কিন্তু টুকু দুরূহ হলেই মনের জোরে চালিয়ে নিয়ে গিয়েছে তার পড়াশুনা। বই খাতা পড়াশুনার খরচ চালানো তাদের সংসারে বিলাসিতা হয়তো। তবে তার অদম্য জেদ তাকে আলাদা করেছে অনেকের থেকে।
জন্মগত প্রতিভা নিয়ে টুকু তার সাধটিকেও স্বজত্নে লালন করেছে। অসম্ভব পারদর্শিতায় নাচ কে করেছে জীবনের সাধনা, কোনও রকম প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া। শুধু মাত্র নাচের প্রতি ভালোবাসা কে সঙ্গী করে কঠিন থেকে কঠিনতর নাচের ভঙ্গিমা সে সিনেমা ও টিভি দেখেই তুলে নিতে পারে অনায়াসেই। সে আজ তার বস্তির ছেলে মেয়েদের নৃত্য শিক্ষিকা। খোলা আকাশের নিচেই চলে তার ক্লাস। গুরু দক্ষিনা পায় চাল ডাল আলু সবজি। কেউ কেউ কখনো দশ – পনেরো টাকা হাতে গুঁজে দেয়। সেই টাকা জমিয়ে টুকু মাধ্যমিক, ও ২০২১ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে। তাতে তার আগামী দিনে আরও কঠিন হয়ে উঠলো। কলেজে ভর্তিতে টাকা কোথায়! পড়াশুনা বন্ধ হবার উপক্রম হলো।
ঠিক এই সময় উত্তর ২৪ পরগণা ফটোগ্রাফারস আয়োজিত ফ্যাশান শো তে বারাসাত সাবডিভিশনাল ফটোগ্রাফারস এসোসিএশনের সদস্যদের সহযোগিতায় নাম নথিভুক্ত করলো টুকু দাস। কিন্তু সে ফ্যাশান শো এর পোশাক কোথায় পাবে, তার তো সেই মহার্ঘ পোশাক কেনার সামর্থ নেই।
হার না মানা লড়াকু মেয়েটা বিভিন্ন দর্জ্জির দোকানে ফেলে দেওয়া টুকরো টুকরো কাপড় সংগ্রহ করে নিজের হাতেই বানিয়ে ফেললো ওই শো এর উপযুক্ত পোশাক। সঙ্গে ওই কাপড়েরই গয়না, এমনকি কাপড়ের জুতো পর্যন্ত। প্রতিযোগিতায় সে প্রথম তিনে আসতে পারেনি কিন্তু জয় ওরই হয়েছিল। ওর কঠিন লড়াই করে উঠে আসার গল্প সংগঠক থেকে উপস্থিত দর্শক কুর্নিশ জানিয়েছিলেন। যেন ফিনিক্স পাখির রূপকথার কাহিনী।
বারাসাত সমন্বযের সম্পাদক প্রসন্ন বসু জানালেন, “প্রথম পর্বের লকডাউন থেকে এখন পর্যন্ত সমন্বয় সেনা হয়ে টুকু দাস সুন্দরবন থেকে বন্ধ কলকারখানা, দৃষ্টিহীন ভিক্ষুক থেকে ইটভাটা, আশ্রয়হীন ভবঘুরে থেকে নিষিদ্ধ পল্লী ত্রাণ নিয়ে ছুটে চলেছে। জগতের কোনো দুর্ণিপাকই টুকুর উড়ান কে রোধ করতে পারেনি। তাই আজ কোনো বাধায় টুকু দাসের কাছে প্রতিবন্ধকতা নয়।