ছড়িয়ে আছে রুটি…

0
1047

অশোক মজুমদার

ট্রেন লাইনের ওপরে ছড়িয়ে আছে রুটি, দলা পাকানো জামাকাপড়, ছেঁড়া ব্যাগ। কিন্তু যাদের জিনিস তারা নেই, শুধু ছড়িয়ে আছে তাদের স্বপ্ন। রুটি-রুজির যে স্বপ্ন তাদের মধ্যপ্রদেশ থেকে মহারাষ্ট্রে টেনে এনেছিল সেই রুটি লাইনে ফেলে রেখেই তারা ঘুমের ঘোরে পাড়ি দিয়েছেন দূর-বহুদূর। মালগাড়ির চাকা তাদের স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে। এক চিত্রসাংবাদিক বন্ধুর পাঠানো ছবিগুলো দেখতে দেখতে একথাই মনে হচ্ছিল আমার। খবরটা শোনার পর মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল, ছবিগুলো দেখার পর অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম।

একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখবেন, যেকোন বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, দাঙ্গা, দেশভাগে উৎখাত মানুষ নেমে আসেন রাস্তায়। নিজেকে বাঁচানোর তাড়নায় পৌঁছতে চান এক নিরাপদ গন্তব্যে। রেল লাইন, সড়ক, মেঠো পথ কিংবা নদীপথ ধরে বেরিয়ে পড়েন তারা। এই করোনার দিনে সড়ক আর রেল লাইন ধরে নিরুপায় মানুষের মিছিল দেখছি আমরা। কাজ বন্ধ, ভোট নেই, পরিকল্পনা নেই, এদের হয়ে কথা বলার মত কোন মানুষও নেই। তাই বেরিয়ে পড়া ছাড়া এদের আর কোন গতি নেই। সবার দরজায় কড়া নেড়ে ব্যর্থ হওয়ার পর এরা ফিরতে চান নিজের গ্রামে। এই শ্রমিকরাও তাই করছিলেন। সে যাত্রা শেষ হল না।

এই ঘটনার পর নিয়মমাফিক যা হয় তাই হবে। রাষ্ট্রের দুঃখপ্রকাশ, দুর্ঘটনার কারণ জানার জন্য তদন্ত কমিশন এবং প্রাণের দাম হিসেবে কিছু ক্ষতিপূরণ সবকিছু পরপর ঘটে যাবে। কিন্তু কেউ প্রশ্ন তুলবেন না, কোন হতাশা থেকে এই মানুষগুলি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রেলপথ ধরে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন? তাদের কর্মস্থলে বা তার আশেপাশে রেখে দেওয়ার মত কোন বিকল্প ব্যবস্থা কী করা যেত না? আসলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের এই মানুষগুলির দায়িত্ব কেউই নিতে চায় না। কাজ ফুরোলে এরাও ফুরিয়ে যান। কেউ মরে যান কেউবা বেঁচে মরে থাকেন। যে গ্রামে তারা ফিরতে চাইছিলেন সেখানে গেলেই কী তারা খুব ভালো থাকতেন? পেটের তাগিদেই তো তারা ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন। অতিমারির সময়ে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের আশ্রয় ও খাদ্যের সংস্থান; এদের বিকল্প কোন কাজে ব্যবহার করার মত পরিকল্পনার অভাব; পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই কর্মক্ষম মানুষগুলিকে রাতারাতি বোঝা ভাবার মানসিকতা এদেরকে দেশে ফিরে যাওয়ার রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য করেছে।

এরপর আমি যা বলবো তা আপনাদের অনেকেরই ভালো লাগবে না। তা হল, আমাদের ঘরবাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এই পরিযায়ী শ্রমিক এমনকি বাইরে থেকে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদেরও আমরা কী চোখে দেখি? এই করোনার সময়ে নিজের উদ্যোগে সামান্য মানবিক পরিষেবা দেওয়ার কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি পাড়ায় থাকা পরিযায়ী শ্রমিক কিংবা হস্টেলে ও এলাকায় ঘর ভাড়া করে একা বা দলবেঁধে থাকা ছাত্রছাত্রীদের এলাকার একশ্রেনির মানুষ নানাভাবে হেনস্থা করছেন। তাদের বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য শাসিয়েছেন। ভাবটা এমন, এরা বেপরোয়া, কোন নিয়মকানুন মানবে না, এদের জন্য আমরাও বিপন্ন হবো। বাড়ি ফিরতে না পারা কলসেন্টার কর্মীদের থেকে মুখ ফিরিয়েছেন স্থানীয় মানুষ, এমনকি থানাও। এমনই কোন মানুষ যদি ক্ষোভে, দুঃখে পায়ে হেঁটেই তার গ্রামে ফিরতে চান, তারপর কোন দুর্ঘটনায় পড়েন, তার দায় কে নেবে? সব দোষ রাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপিয়ে ভালো মানুষ সাজলে চলবে!

করোনা একটা সময়ে পরাস্ত হবে। পৃথিবী কিন্তু আর ঠিক আগের অবস্থায় ফিরবে না। অবস্থা স্বাভাবিক হবে ঠিকই কিন্তু তা হবে নতুন স্বাভাবিকতা। যাকে এখন বলা হচ্ছে নিও-নর্মাল। মানুষকে মানুষের মত দেখতে না শিখলে, দুরাবস্থায় তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইলে নিজেদের বেঁচে থাকাও কিন্তু কঠিন হবে।

Previous articleএকুশ দিন সম্পূর্ণ লকডাউন বনগাঁ শহর
Next articleদক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি এলো ঝেঁপে, বইবে ঝোড়ো হওয়া, জানাল আবহাওয়া দপ্তর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here