কল্পতরু দিবস বাঙলির চৈতন্য জাগরণের দিন : ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

0
900

একজন রোগী যখন সংজ্ঞাহীন মৃতবৎ হয়ে পড়ে, কোমায় চলে যায়, মেডিকাল সায়েন্সে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে তার চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। একইভাবে স্পিরিচুয়াল হাসপাতাল তৈরি করলেন শ্রীচৈতন্যদেব। ভারতবাসীর মধ্যে সত্যিকারের চৈতন্য-বিকাশ ঘটালেন। ১৪৮৬ সালে নবদ্বীপে আবির্ভূত হলেন সেই ডাক্তার; ১৫১০ সালে তাঁর ডাক্তারি পাশ করা হল; কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস মন্ত্রে দীক্ষা নিলেন এ যুগের ব্রজেন্দ্র নন্দন, নাম হল ‘শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য ‘। তারপর প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের ব্যবধান; আজ থেকে ১৩৫ বছর আগে চৈতন্য বিজ্ঞানের আসরে অবতীর্ণ হলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব। ১৮৮৬ সালের ১ লা জানুয়ারি কাশীপুর উদ্যানবাটিতে তিনি কল্পতরু হলেন; বললেন, “চৈতন্য হোক”, জীবনের পরম-প্রাপ্তি ঘটুক। মনে পড়বে শাক্ত-সংগীত,”আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী।”

ঈশ্বর যখন সাকাররূপ ধারণ করে আসেন এবং ব্যক্তস্বরূপে লীলাবেশ ধারণ করেন, তখন তিনি অবতাররূপে গণ্য হন। রামরূপে তিনি ‘বারোয়ানা’ আর কৃষ্ণরূপে তিনি ‘ষোলোয়ানা অবতার’। অবতাররূপে যখন তিনি ‘সর্ব অবতারী’, তখনই তিনি ‘অবতার-বরিষ্ঠ’।

১৮৮৬ সালের ১ লা জানুয়ারি শ্রীরামকৃষ্ণ কল্পতরু হয়েছিলেন। বাঙালি তথা বিশ্ববাসীকেই চৈতন্য জাগরণের আশীর্বাদ করেছিলেন। তাই তাঁর অবতারত্বে বাঙালি অবগাহন করতে চেয়েছে চৈতন্যের সমুদ্র। কিন্তু বেছে বেছে খ্রীস্টীয় ক্যালেণ্ডারের প্রথম দিনটিকে ভারতবর্ষে ‘কল্পতরু’-র ভাব-আয়োজন কেন করলেন? কেনই বা তাঁর প্রধান শিষ্য ১৮৮৬ সালের ২৪ শে ডিসেম্বর হুগলির আঁটপুরে সন্ন্যাসীর-ধুনি জ্বালালেন? কেনই বা ১৮৯২ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর কন্যাকুমারীর শিলাতে বসে অখণ্ড ভারতের সাধনায় নিমগ্ন হলেন স্বামীজি? কেনই বা কলোনিয়াল ফেস্টিভ্যালের মেজাজে প্রতিস্পর্ধী হিন্দুত্বের বাতাবরণ তৈরি হল? কেন পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের স্মৃতিধন্য হয়ে পয়লা জানুয়ারির মধ্যে ব্যাপক ছোঁয়া লাগলো? এসব কী নিছকই এক একটি দিন? নাকি একটি প্রতিস্পর্ধী প্রভাব থেকে সনাতনী হিন্দু সমাজকে উত্তরণে নিয়ে যাওয়ার ঐশী-প্রয়াস এই দিনগুলি? বাঙালি কি কল্পতরু দিবস যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করে দেখেছে?

দেশীয় সংস্কৃতি ও শিক্ষার ধারা পরিবর্তন করে মেকলে সাহেব ১৮৩৫ সালে যে শিক্ষানীতি প্রচলন করতে চাইলেন, পরের বছরেই তা ভাঙ্গার আয়োজন হল। ১৮৩৬ সালে জন্ম নিলেন পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ। “তোমারে বধিবে যে/গোকুলে বাড়িছে সে।” কলোনিয়াল-কৌশল ভাবজগতে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেবার জন্য আবির্ভূত হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তিনি অপ্রকটের পূর্বে ঔপনিবেশিক ভাবধারাকে পরাজিত করে যাবেন, তা এক প্রকার নিশ্চিতই ছিল। তাই দেখা গেলো ১৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে খ্রীস্টীয় ক্যালেণ্ডারের পাতায় জ্বলজ্বল করছে এক অহৈতুকী কৃপালাভের আনন্দঘন দিন। কল্পতরু উৎসব। ভারতবর্ষ আপন সৌকর্যে অতিক্রম করেছে সাম্রাজ্যবাদের চিহ্নমাখা দিনগুলি।

কল্পতরু উৎসব কেন তাৎপর্যপূর্ণ? কারণ এটি খ্রিস্টীয় ক্যালেণ্ডারের প্রথম দিন, বড়দিন থেকে শুরু হওয়া উইন্টার ফেস্টিভ্যালের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। বর্ষবরণের দিন। আর প্রথম দিনেই কলোনিয়াল ফেস্টিভ্যাল ‘বোল্ড আউট’ হয়ে গেল হিন্দুয়ানীর পবিত্র ছোঁয়ায়। রক্তপাতহীন নীরব এক আধ্যাত্মিক যুদ্ধ। এরই নাম স্পিরিচুয়াল রেভোলিউশন। এটা যে কত বড় জয়, তা যতই সময় পেরোবে, ততই অনুভূত হবে।

শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে ত্যাগের অপরিসীম শক্তি তীব্র প্রখরতায় বিচ্ছুরিত হয়েছিল। তাঁর মধ্যে মৃত্যুতুল্য সমাধিস্থ থাকার অসামান্য ক্ষমতা ছিল। ছিল স্পর্শ দিয়ে অন্যকে আধ্যাত্মিক উপলব্ধিতে জারিত ও সঞ্জীবিত করার অলৌকিক ক্ষমতা। দেবত্বের উপলব্ধি ছিল তাঁর। ছিল সাধন-শিখরের চূড়ার পৌঁছানোর নজির। যুগের বিশেষ প্রয়োজনেই তাঁর মত্যে আসা। ১৮৩৫ সালে মেকলের ভারতীয় সংস্কৃতি-বিধ্বংসী শিক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনার পরের বছরই তাঁর আবির্ভাব। একজন কেতাবী-বুদ্ধি-হীন গ্রাম্যযুবক কী করে লাভ করেছিলেন শাস্ত্রবিচারের অনন্য জ্ঞানভাণ্ডার? কী করে পেয়েছিলেন অনন্ত-অমৃতলোকের চাবিকাঠি? দুই কাঁধে বিবেক-বৈরাগ্যের ঝোলা নিত্য ঝুলিয়ে রাখতেন কীভাবে?

গীতার জ্ঞানযোগের ষষ্ঠশ্লোকে আছে — আমি জন্মরহিত, আমার চিন্ময় দেহ যদিও অব্যয়; যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর; তবুও আদি চিন্ময়রূপে আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করি এবং যুগে যুগে আবির্ভূত হই। ঈশ্বরের এই আবির্ভূত সত্তাই হলেন অবতার। তিনি ‘কর্মহীন’, অর্থাৎ কর্মফলের জন্য তাঁকে ধরাধামে আসতে হয়েছে, তা নয়। তিনি কৃপা করেই আসেন, মানব কল্যাণের জন্যই আসেন এবং মানুষের দেহ ও মন নিয়েই জন্মগ্রহণ করেন। কোনো মায়াডোর তাঁকে বেঁধে রাখতে পারে না, তিনি ‘মায়াধিপতি’। পুণ্যাত্মা সাধক আর অবতার অভিন্ন পদবাচ্য নয়।

ভৈরবী ব্রাহ্মণী দক্ষিণেশ্বরের ভরা নাটমঞ্চে পণ্ডিতদের মাঝখানে যেদিন প্রমাণসহ শ্রীরামকৃষ্ণের অবতারত্ব ব্যাখ্যা করেছিলেন, সেদিনও কী সমকাল বুঝেছিল তাঁর সংজ্ঞা-স্বরূপ-বৈশিষ্ট্য? বুঝলেন তখনই যেদিন তিনি নিজে আত্মপ্রকাশ করলেন। অভয় দান করলেন। যেদিন অহৈতুকী কৃপাসিন্ধু হয়ে, পতিতপাবন রূপে নিজেকে শীতের এক বিকেলে নিজেকে অনাবৃত করলেন। ভক্তরা দেখতে পেলেন অবতারের রূপমাধুরী। “মনে হয় অঙ্গবাস সব দিয়া খুলি।/নয়ন ভরিয়া দেখি রূপের পুতুলি।” সেটা ১৮৮৬ সালের ১ লা জানুয়ারি। কলকাতার কাশীপুর উদ্যানবাটি। যেদিন তিনি অন্তরঙ্গ-পার্ষদ ও ভক্তমণ্ডলীর কাছে অভাবনীয়ভাবে আত্মপ্রকাশ করলেন।

এই কল্পতরু লীলা-কাহিনী নানান গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। যেমন স্বামী সারদানন্দ রচিত ‘লীলাপ্রসঙ্গ’-এ, কবি অক্ষয়কুমার সেন বিরচিত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথি’-তে, শ্রীম কথিত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’-এ। স্বামী অভেদানন্দ রচিত ‘আমার জীবনকথা’ গ্রন্থের বিবরণ কিয়দংশ উদ্ধৃত করছি। শ্রীরামকৃষ্ণ তখন গলায় দুরারোগ্য কর্কট রোগে আক্রান্ত। সেদিন অফিস ছুটির দিন। বিকেলে বাগানবাটিতে এসেছেন গিরিশ ঘোষ সহ গৃহস্থ ভক্তরা। সেবক-পার্ষদরাও রয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ এদিন কিছুটা সুস্থ অনুভব করে দোতালা থেকে নীচে নেমে বাগানে হাঁটছেন। এরই মধ্যে গিরিশ ঘোষের সঙ্গে কথা হল। ঐশী সংলাপে ঠাকুর বাহ্যজ্ঞানশূণ্য হলেন। ভাবাবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। সংজ্ঞালাভ করে সবাইকে আশীর্বাণী দিলেন, ‘তোমাদের চৈতন্য হোক্’। সকলকে স্পর্শ করলেন, তাদের অধ্যাত্ম-আঁখি খুলে দিলেন, সকলের সকল প্রার্থনা পূরণ করলেন। “ভাই ভূপতি সমাধি প্রার্থনা করিয়াছিল। তাহাকে শ্রীশ্রীঠাকুর কৃপা করিয়া বলিয়াছিলেন, ‘তোর সমাধি হবে’। উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত গরীব অবস্থায় অর্থাভাবে কষ্ট পাইতেছিলেন বলিয়া অর্থ প্রার্থনা করিয়াছিল। শ্রীশ্রীঠাকুর তাহাকে কৃপা করিয়া বলিলেন, ‘তোর অর্থ হবে।’ রামলালদাদা, বৈকুন্ঠ সান্যাল প্রভৃতি গৃহস্থ-ভক্তদিগকে তাহাদের যাহা যাহা প্রার্থনা ছিল, তাহা তিনি আশ্বাস দিয়া ‘পূর্ণ হবে’ বলিয়া কৃপা করিলেন।”

ঔপনিবেশিক শাসনে থাকবার পর মানুষ স্বভাবতই তাদের ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়, নতুবা নানান মত ও পথে তা অতিক্রমণ করতে মনস্থ হয়, কখনও কখনও ঔপনিবেশিক শক্তির মান্য ধর্মকে তীব্রভাবে অস্বীকার করার মানসিকতা জন্মায়। ব্রিটিশ শাসনে থেকে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের হয়তো সেই ধর্মীয় পরিমণ্ডল অতিক্রম করার জন্য তাদের প্রথম দিনটিকেই গ্রহণ করেছিলেন। আর সেই দিনটির মধ্যে হিন্দুধর্মের নবযুগের ইতিহাস রচনা করতে চাইলেন। তাঁর শিষ্যও তাঁকে অনুসরণ করলেন। ২৪ শে ডিসেম্বর ‘ক্রিসমাস ইভ’ হয়ে গেলো ‘ত্যাগব্রত দিবস’।

১৮৮৬ সালের বড়দিনের পূর্বসন্ধ্যায় (১৩ ই পৌষ, ১২৯৩) নয়জন গুরুভাই হুগলীর আঁটপুর গ্রামে বাবুরাম ঘোষের (শ্রীরামকৃষ্ণ পার্ষদ, পরবর্তীকালে স্বামী প্রেমানন্দ) বাড়িতে উপস্থিত হয়ে ভারতের অধ্যাত্মিক ও সামাজিক কল্যাণে সন্ন্যাস গ্রহণের সংকল্প করলেন। অন্যদিনও তো করতে পারতেন, কারণ আঁটপুরে তার বেশ কয়েকদিন আগেই তিনি পৌঁছেছিলেন। মনে রাখতে হবে ১৮৮৬ সালেই আগষ্ট মাসে ঠাকুরের শরীর যায়। সেদিন অশ্বত্থ তলায় ধুনি জ্বেলে তাঁরা বসলেন গভীর ধ্যানে, ঈশ্বর আলোচনা করলেন।

দ্বিতীয় ঘটনা ১৮৯২ সালের ২৫,২৬,২৭ শে ডিসেম্বরের; স্থান কন্যাকুমারী। আবারও ২৫ ডিসেম্বরকে ব্যবহার করলেন স্বামীজি। তিনি অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ডাইনে-বামে-পশ্চাতে ঢেউ আর ঢেউ, অগণিত অনন্য; মহাসাগরের বুকে মিশে যেতে চায় সাগর আর উপসাগর — অনাদি কাল থেকে তাদের অভিসার যাত্রা। ১৮৯২ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর; আকাশের এক তারা এসেছেন মত্যসাগরের ত্রিকোণ প্রেমের জলধারায় নীলকর দিয়ে। সুনীল জলধি থেকে সন্তানসম ভারতবর্ষের আবির্ভাব; মহাকালের সেই মহান অধ্যায় দেখতে এসেছেন সপ্তর্ষিমণ্ডলের এক আশ্চর্য নক্ষত্র; তার অতীত আর ভবিষ্যৎ মেলাবেন সমাধিতে বসে। পাশেই সমুদ্র-তনয়া কন্যাকুমারী। বড়দিন-ই বটে, তার প্রাক্কালে পায়ে হেঁটে কন্যাকুমারী পৌঁছেছেন স্বামী বিবেকানন্দ, তারপর মূল ভূখণ্ড থেকে সাগর-সঙ্গমে ৫০০ মিটার সাঁতরে ভারতীয় পাহাড়ের শেষ বিন্দুতে পৌঁছলেন তিনি; তারপর অতুল্য কিন্তু অভুক্ত ভারতের জন্য গ্রহণ করলেন এক অধ্যাত্মিক সংকল্প। ধ্যানের শঙ্খনাদে একাদিক্রমে তিনদিন কাটলো — ২৫,২৬,২৭ শে ডিসেম্বর।

যে খ্রীস্টান ধর্ম মানুষকে ‘পাপী’ বলে, সেই ধর্মের প্রতিবাদ কেবল স্বামীজিই করেন নি, করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেবও। মানুষ দেবতা, মানুষ ব্রহ্ম; সে পাপী হবে কীভাবে? সে অমৃতের সন্তান, সে পবিত্র, সে পূর্ণ; পূর্ণতা প্রাপ্তির সব যোগই তার মধ্যে আছে।

স্বামীজি জানতেন একদিন শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবমহামণ্ডলে ভারতসহ প্লাবিত হবে বিশ্বের নানান অংশ। তাই বড়দিনের মত দিনটির মধ্যে ‘সনাতনী-বীজ’ বপন করে দিলেন তিনি। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর পথ প্রদর্শক। এটা কলোনিয়াল প্রভাবমুক্তিরই সাধনা, সাধনা ২৫ শে ডিসেম্বর ও পয়লা জানুয়ারিকে অতিক্রমের। এই দিনে বরং বেশী করে শ্রীরামকৃষ্ণের ও স্বামী বিবেকানন্দের স্মরণ-মনন ও পূজন জরুরী। জরুরী শ্রীরামকৃষ্ণ-স্বামীজি যুগলবন্দীর আরাধনা।

Previous articleDrama: বর্ষ শেষে কোভিড বিধি মেনে গোবরডাঙা রূপান্তর নাট্যোৎসব অনুষ্ঠিত হলো তিন দিন
Next articleউত্তরবঙ্গবাসীদের তীর্থযাত্রার জন্য চালু হতে চলেছে রামপথ দর্শন ট্রেন , নিউ কোচবিহার থেকে ছাড়বে ,যাবে কাশী, হরিদ্বার, বৃন্দাবন রইল বিস্তারিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here