

অর্ণব কুমার দে , কলকাতা : গুরুপূর্ণিমার পবিত্র দিনে কলকাতার এক মননশীল সাংস্কৃতিক পরিসরে আত্মপ্রকাশ করল এক অসাধারণ গ্রন্থ— ‘মনীষী বিচিত্রা’, যা বাংলার গর্ব, আত্মপরিচয় এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জাগরণে এক নতুন সংযোজন। বইটি যৌথভাবে রচনা করেছেন তরুণ গবেষক ও চিন্তাশীল লেখক অরিত্র ঘোষ দস্তিদার এবং প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. কল্যাণ চক্রবর্তী। গুরুপূর্ণিমা উপলক্ষে এই গ্রন্থের আত্মপ্রকাশ নিছক কাকতালীয় নয়— এটি শিষ্য ও গুরুর আদর্শিক সম্পর্কের এক প্রগাঢ় নিদর্শন। অরিত্র বলেন, “এই গ্রন্থ আমার জীবনের দিকদর্শক, আমার গুরু ড. কল্যাণ চক্রবর্তীর প্রতি একান্ত শ্রদ্ধার্ঘ। তাঁর অনুপ্রেরণাই আমার চিন্তার পথ নির্মাণ করেছে।”
বইটি মূলত বাংলা তথা ভারতের ১৪ জন বিশিষ্ট মনীষীর জীবন ও কর্ম নিয়ে লেখা। আধ্যাত্মিক জগত, শিক্ষাক্ষেত্র এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিন্ন ভিন্ন পরিসরে যাঁরা সময়কে অতিক্রম করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, তাঁদের কাহিনি সংকলিত হয়েছে এই গ্রন্থে। আধ্যাত্মিক পরিসরে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন রামপ্রসাদ, স্বামী বিবেকানন্দ, সিস্টার নিবেদিতা এবং শ্রী রামকৃষ্ণ— যাঁদের ভাবধারা ভারতীয় আত্মার আদি উৎসকে প্রকাশ করে। শিক্ষাক্ষেত্রে তুলে ধরা হয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার এবং বেথুন সাহেবের কর্ম ও দৃষ্টিভঙ্গি— যাঁরা সমাজ গঠনের ভিতকে শিক্ষা দিয়ে শক্তিশালী করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে উঠে এসেছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, বিপিনচন্দ্র পাল, দীনেশচন্দ্র গুপ্ত, প্রফুল্ল চাকী ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যাঁর ‘ভারতমাতা’ চিত্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদের চিত্ররূপ হয়ে উঠেছিল।


এই বইয়ের প্রচ্ছদ ঘিরে লেখক অরিত্র ঘোষ দস্তিদার এক ব্যতিক্রমী ব্যাখ্যা তুলে ধরেন যা অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলকে আবেগপ্রবণ করে তোলে। তিনি বলেন, “এই প্রচ্ছদ কেবল রঙ নয়, একটি দর্শন। আমরা জাতীয় পতাকার তিনটি রঙের প্রতীকীতা ব্যবহার করেছি— গেরুয়া রঙ প্রতিনিধিত্ব করে আধ্যাত্মিক মনীষীদের, যেমন বিবেকানন্দ বা রামপ্রসাদ; সাদা রঙ বোঝায় শিক্ষা ও চিন্তার মুক্তিকে, যা বিদ্যাসাগর বা বেথুন সাহেবের মত মনীষীদের আদর্শ; এবং সবুজ রঙ তুলে ধরে সেই চিরসবুজ আত্মত্যাগ— নেতাজি, প্রফুল্ল চাকী, দীনেশচন্দ্রদের রক্তে যে স্বাধীনতা এসেছিল।” এই ব্যাখ্যা শুধু প্রচ্ছদের রঙ ব্যাখ্যা করে না, বরং পুরো বইয়ের কাঠামো ও দৃষ্টিভঙ্গিকেই একত্রে প্রকাশ করে।
গ্রন্থটি নিছক জীবনীসংকলন নয়, বরং তা এক আদর্শভিত্তিক চিন্তার সঞ্চার ঘটাতে চায়। বর্তমান সময়ে, যখন ইতিহাসের অপব্যাখ্যা বা বিকৃতি জনমানসে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে, তখন এই বই এক নির্ভরযোগ্য আলোচনার রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এটি পাঠককে শুধু অতীত জানায় না, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি মানসিক কাঠামো নির্মাণে সাহায্য করে। তরুণ প্রজন্মের কাছে এই বই হবে আত্মপরিচয়ের একটি মানচিত্র— যেখানে শিকড়ের সন্ধান, সংস্কৃতির গর্ব এবং জাতীয় কর্তব্যের প্রেরণা সবই মিলবে একসাথে।

অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অতিথিরা বলেন, এই বই এক সাংস্কৃতিক ও মননশীল আন্দোলনের দিশারী। কেউ বলেন এটি ‘জাগরণের দলিল’, কেউ বলেন ‘চেতনাসম্পন্ন ইতিহাসচর্চার নবদিগন্ত’। একটি মন্তব্য বিশেষভাবে আলোচনায় উঠে আসে— “মনীষী বিচিত্রা আমাদের শেখায়, ইতিহাস শুধুমাত্র অতীত নয়, ইতিহাস ভবিষ্যতেরও আয়না। আর সে আয়নাতে যদি আমরা মনীষীদের দেখার অভ্যাস করি, তবে পথ হারাব না কখনও।” গুরুপূর্ণিমার এই শুভক্ষণে, গুরু ও শিষ্যের একত্র চিন্তার ফসল হিসেবে ‘মনীষী বিচিত্রা’ নিঃসন্দেহে একটি অনন্য সংযোজন — যা ভারতের অতীতের গৌরব ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে এক মলাটে আবদ্ধ করেছে।



