

ঈশানী মল্লিক, দেশের সময় :কর্মক্ষেত্র একটি সামাজিক ও পেশাগত মঞ্চ, যেখানে মানুষ পারস্পরিক সম্পর্ক, নিয়ম, ধারণা, প্রত্যাশা ও কর্তৃত্বের পার্থক্যসহ কাজ করে। কখনও কখনও, কেউ আপনার সাথে অযথা খারাপ ব্যবহার করতে পারে, অপমান বা অবজ্ঞাসূচক কথা বলতে পারে, বা অনৈতিক আচরণ করতে পারে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে নিজেকে রক্ষা করা, মর্যাদা বজায় রাখা ও ন্যায্যতার দিক থেকে কাজ করা জরুরি।

গবেষণা বলছে,
১. Assertiveness ও সাধারণ ফলাফল:
“Assertive behaviour” মানে নিজের ভাবনা, অনুভূতি ও অধিকার স্পষ্টভাবে, সম্মানজনক উপায়ে প্রকাশ করা। গবেষণায় দেখা গেছে, যখন কর্মীরা তাদের সমস্যাগুলো নিরপেক্ষ ও স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন, তখন তাদের আত্মসম্মান বৃদ্ধি পায়, কাজের সন্তুষ্টি বাড়ে এবং উৎপাদনশীলতা উন্নত হয়।
২. অপব্যবহার, হয়রানি ও বুলিং:
ওয়ার্কপ্লেসে বুলিং বা অপব্যবহারের ধরণ যেমন: অবমাননাকর কথা, অবদমন (verbal abuse), ক্ষমতার অপব্যবহার, মানসিক হয়রানি—এইগুলো কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যে খারাপ প্রভাব ফেলে।

৩. নৈতিক নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক সংস্কৃতি:
একটি প্রতিষ্ঠানে নেতাদের আচরণ ও নীতিমালা যদি নৈতিকভাবে উচ্চাঙ্গ হয়, তাহলে কর্মীদের বলিষ্ঠভাবে কথা বলার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কর্মসংস্কৃতি এবং নৈতিক নির্দেশিকা স্পষ্ট থাকলে, কেউ অন্যায় করলে তা চিহ্নিত করার ঘাটতি কমে।

৪. প্রতিক্রিয়ার ভয় এবং স্ব-প্রমাণ (self-esteem) ও সাইকোলজিকাল এমপাওয়ারমেন্ট:
অনেকেই অন্যায় হলে মুখ খুলতে ভয় পান—নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া, চাকরিতে ক্ষতি, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদির আশঙ্কায়। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, যারা স্ব-প্রমাণ ধরে রাখে, তাদের আত্মসম্মান ও “psychological empowerment” বাড়ে, কাজের পারফরম্যান্স ভালো হয়।
৫. দুর্ঘটনামূলক পরিস্থিতি ও রিপোর্টিং:
অনেকে লেখা-আঁকা রেকর্ড রাখেন না, অভিযোগ জানানোর ধারা অনুসরণ করেন না। গবেষণায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে, অনৈতিক ব্যবহার বা হয়রানির ঘটনার লেখা সাক্ষ্য (emails, মেসেজ, সময়, দৃশ্যমান সাক্ষী) রাখা উচিত।

কী করণীয়
নিচে কিছু প্র্যাকটিক্যাল পরামর্শ দেওয়া হলো যা অনুসরণ করলে নিজেকে নিজের হাতিয়ার করে তোলা সম্ভব:
আত্মপরিচয় ও নিজের মূল্য বোঝা
আপনি কারও জন্য নির্ধারিত নয় যে তারা আপনার মর্যাদা কমিয়ে বলবে। নিজের দক্ষতা, কাজ ও অবদান বোঝা ও মেনে নেওয়া জরুরি।

চিন্তা-চেতন ও প্রস্তুতি
— আগে বিষয়টি ঠিকমতো ভাবুন: কী হয়েছে, কখন ও কোথায় হয়েছে, কে জড়িত, সাক্ষীরা কে।
— কী বলবেন, কোনভাবে বলবেন—মৃদু ও স্পষ্টভাবে, অপরের অনুভূতিও বিবেচনায় রাখা দরকার।
— আপনি কী চান: ক্ষমা, ব্যাখ্যা, আচরণ পরিবর্তন, লিখিত ঘোষণা, হেয়ারিং?
সম্মানজনক ও সক্রিয় যোগাযোগ (Assertive Communication)
— “আমি” ভাষার ব্যবহার (“আমি অনুভব করি…”, “আমার মতে…”), অভিযোগ বা আক্রমণ নয়।
— সংলাপ চাওয়া, কথা বলার সময় চাওয়া (মিটিং, ব্যক্তিগত ও শান্ত পরিবেশে)।
— বিষয় বস্তুনিষ্ঠ রাখা: অনুভূতি ও বিষয়বস্তু মিশ্রিত না করা; অবমাননাকর কথার পরিবর্তে কাজ ও আচরণ নিয়ে আলোচনা।
লিখিত রেকর্ড রাখা
— ইমেইল, মেসেজ, নোট: সময় ও তারিখ সহ।
— সাক্ষীর কথা: যদি কেউ দেখেছে বা শুনেছে, তবে তাকে উল্লেখ করা যেতে পারে।
উচ্চতর কর্তৃপক্ষ (HR) বিভাগকে জানান
— বিষয়টি যদি পরিবর্তন না হয় বা সমস্যা বাড়ে, তাহলে অফিসিয়াল চ্যানেলে অভিযোগ করা উচিত।
— প্রমাণসহ এবং শান্তভাবে উপস্থাপন করা উচিত।
নিজেকে আইনগত এবং নৈতিক সীমার মধ্যে রাখা
— দেশের শ্রম আইন, প্রতিষ্ঠানের নীতি ও আচরণবিধি জানুন।
— কখনও উগ্র বা অশোভন আচরণ করা উচিত নয়।
মানসিক ও সামাজিক সমর্থন খোঁজা
— বিশ্বস্ত সহকর্মী, বন্ধু বা পরিবারকে বিষয়টি বলুন; কথা বললে বোঝাপড়া তৈরি হয়।
— প্রয়োজনে কাউন্সেলিং বা পেশাদার পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
কী করণীয় নয়:
নিজে কিছু কাজ যা মোটেও করা উচিত নয়, কারণ তারা সমস্যা বাড়াতে পারে বা নিজেকে ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে:
আক্রমণাত্মক হওয়া / গালি-গালাজ করা
— রাগে বা উত্তেজনায় কথা বলা, গালি দেওয়া।
অস্পষ্টভাবে কথা বলা বা ঘুরিয়ে সাজিয়ে বলা
— যেটি বলা উচিত, সেটি স্পষ্টভাবে বলুন।
অপমান বা হুমকি
— হুমকি দেয়া, ভয় দেখানো, কাউকে ভয়ভীতি দেখানো—এসব সবই পেশাগত ও নৈতিকভাবে ভুল।
কোনো তথ্য মিথ্যে বলা বা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা
— প্রমাণ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সত্যিই যা হয়েছে তা রেকর্ড করা; মিথ্যাচার করলে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে।
ইতিবাচক সম্পর্ক নষ্ট করা অবিবেচকভাবে
— সহকর্মী ও কর্তৃপক্ষের সাথে সম্পর্ক পুরোদমে খারাপ করে ফেলা উচিত নয়; পেশাদার সীমা বজায় রেখে কাজ করা ভালো।
চুপ থাকা ও ভয় পেয়ে নিজেকে পীড়িত অবস্থায় রাখা
— নীরব থাকলে অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে; অনুভূতির অবিচারিত অবস্থা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর।
অবৈধ বা বৈধ নয় এমন পথে যাওয়া
— কেউ হয়রানি করলে আইনগত পথে যেতে পারেন, কিন্তু আইন লঙ্ঘন করা বা গোপনে প্রতিশোধ নেওয়া—এতে নিজেই প্রাণহানি বা পেশাগত ক্ষতি হতে পারে।
কর্মক্ষেত্রে আত্মরক্ষার একটা চেকলিস্ট দেওয়া হল:
ধাপ ১: নিজের অবস্থান বোঝা
কী ঘটেছে লিখে রাখুন (সময়, তারিখ, স্থান, কারা ছিল)।
আপনার অনুভূতি সঠিকভাবে চিহ্নিত করুন (অপমান, হতাশা, অন্যায় ইত্যাদি)।
ধাপ ২: শান্ত থাকা
গভীর শ্বাস নিন, সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া দেবেন না।
নিজের ভাষা সম্মানজনক রাখুন।
ধাপ ৩: স্পষ্টভাবে বলা (Assertive Communication)
“আমি” দিয়ে বাক্য শুরু করুন। যেমন: “আমি এতে অস্বস্তি বোধ করছি”।
সরাসরি কিন্তু ভদ্রভাবে বলুন—ঘুরিয়ে বা আক্রমণাত্মকভাবে নয়।
ধাপ ৪: প্রমাণ রাখা
ইমেইল/মেসেজ/নোট সংরক্ষণ করুন।
সাক্ষী থাকলে তাঁদের নাম লিখে রাখুন।
ধাপ ৫: অফিসিয়াল পদক্ষেপ
প্রথমে সরাসরি ব্যক্তিকে জানান।
কাজ না হলে HR / সুপারভাইজারকে লিখিতভাবে জানান।
প্রয়োজনে অভিযোগের অফিসিয়াল প্রক্রিয়া অনুসরণ করুন।
ধাপ ৬: মানসিক সমর্থন
বিশ্বস্ত সহকর্মী/বন্ধু/পরিবারের সাথে শেয়ার করুন।
কাউন্সেলিং বা বিশেষজ্ঞ সাহায্য নিন, যদি চাপ বেশি হয়।

এই তালিকাটা আপনি নিজের ডেস্কে/ডায়েরিতে রেখে প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারেন।
নিজেকে নিজের হাতিয়ার করে তোলার অর্থ হলো নিজের অধিকার, মর্যাদা ও আত্মসম্মান রক্ষার জন্য সচেতনভাবে, শান্তভাবে ও নৈতিকভাবে কাজ করা। এটি কোনও দ্বন্দ্ব নয়, বরং নিজের স্বার্থ ও মানসিক এবং পেশাগত সুস্থতার জন্য একটি নিরাপদ ও সংহত সিদ্ধান্ত।