যতদূর মনে পড়ছে ‘হিউম্যান রিসোর্স’ কথাটা ৮০র দশকের শেষ দিক থেকে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। সোজা বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় মানব সম্পদকে সংরক্ষণ ও বিকশিত হতে সাহায্য করা। কিন্তু করোনার দুঃসময়ে সংবাদপত্রের কর্মীদের কাছে কথাটা হয়ে উঠেছে একটা আতঙ্ক। মালিকের পেটোয়া ‘হিউম্যান রিসোর্স’ ডিপার্টমেন্টের সুপারিশে গোটা দেশজুড়ে চলছে নির্বিচার কর্মী ছাঁটাই। কথাটার মানেই বদলে গেছে। কর্মীদের বিকশিত হতে সাহায্য করার বদলে ‘হিউম্যান রিসোর্স’ ডিপার্টমেন্ট হয়ে উঠেছে ইনহিউম্যান কাজের আখড়া, একটা স্লটার হাউস। মালিকদের ফাইফরমাশ খাটা মোটা মাইনে পাওয়া কিছু ‘সাংবাদিক’, একদা যারা প্রগতিশীলতার জয়গান গাইতেন তারা এখন হয়ে উঠেছেন জহ্লাদের সহকারী। মানুষের দুঃসময় হয়ে উঠেছে মালিকের মুনাফা বাড়ানোর সুসময়।
অবশ্য করোনার আগে থেকেই এই অপকর্মটি শুরু হয়েছে। এখন তার দাপট আরও বেড়েছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা চিত্রসাংবাদিকদের। মোবাইল আসার পর ছবি তোলা সহজ হয়েছে, কমেছে চিত্রসাংবাদিকদের কদর। টিভি, সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটে আমরা চিত্রসাংবাদিকরা ব্রাত্য। তারা হাঁটছেন কর্মচ্যুত পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গেই। খবরের কাগজের দিন এখন অদ্ভুতভাবে শুরু হয়। যখন সাংবাদিক, চিত্রসাংবাদিকরা ভাবছেন, কী খবর হবে বা কী ছবি হবে, তখনই আসছে এইচআর কর্তার মিঠে-কড়া ফোন। তিনি জানাচ্ছেন, ‘কম্পানির এখন খারাপ অবস্থা, আমরা লোক রাখতে পারবো না।’ মরে যাওয়ার পর মানুষ যেমন ‘বডি’ হয়ে যায় ঠিক তেমনি তাড়ানোর বেলায় অফিসের জন্য ২০-২৫ বছর ধরে নিজের জীবন-যৌবন দিয়ে দেওয়া কর্মীটি এইচআর এবং দালাল সম্পাদকের কাছে হয়ে ওঠেন ‘লোক’! অবলীলাক্রমে তারা বলে চলেন, ‘আপনি আজই মেল-এ রিজাইন করুন। দু’মাসের টাকা এক্সট্রা পেয়ে যাবেন। ক্যামেরা, কার্ড আপনার কাছে যা আছে আমাদের লোক গিয়ে নিয়ে আসবে। কাল থেকে আপনি আর হাউসে নেই।’ বাড়ির কুকুর, বেড়ালকেও মানুষ এভাবে তাড়ায় না!
বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে যা অভিজ্ঞতার কথা শুনি তাতে চোখ ফেটে জল আসে। সদ্য ছাঁটাই হওয়া নামী কাগজের এক দক্ষ সাংবাদিক কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন, দেখুন, আমার দুটো ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে, বাড়িতে বৃদ্ধা মা ও স্ত্রী। সংসারে আমিই একমাত্র রোজগেরে, চাকরি গেলে খাবো কী? ভাড়া বাড়িতে থাকি, আমাকে আর কয়েক মাস রাখুন। নিদেন পক্ষে ক্যামেরাটা দিন, বিয়ে বাড়ির ছবি তুলে পেট চালাবো। কেউ এদের কথা শোনেনি। কেউ বলেছেন, ফ্ল্যাটের ইএমআই বাকি আছে, এখন চাকরি গেলে মাথার ছাদটুকুও থাকবে না। এদের কেউ ২০-২৫ বছর ধরে কাগজে/টিভিতে কাজ করেছেন, ছবি তুলেছেন।
আনন্দবাজারে আমার এক প্রাক্তন সহকর্মী বলছিলেন, অশোকদা আমি লেখালেখি ছাড়া আর কিছু করতে পারিনা। আমি ছোট থেকেই এত দুর্বল ও অসুস্থ যে আমার নিজেরই মাসে সাত হাজার টাকার ওষুধ লাগে। বাড়িতে ছেলে, বউ, মা আছে। এই সাংবাদিকটিকে বড় হাউস থেকে বেশি টাকা মাইনেতে জোর করে অন্য হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সত্যিই ভালো লেখেন, সোশ্যাল মিডিয়াতে তার লেখা ভাইরাল হয়। করোনার বাজারে রাতারাতি তার চাকরি গেছে। এই মানুষটি অন্য কোন কাজে যেতেই পারবেন না।
এ যেন এক কুহকের দেশ। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট পাওয়া মেধাবী ছেলেমেয়েরা যখন সাংবাদিক হতে আসেন তখন তারা কেউই ভাবেন না এই পেশায় আচমকা যবনিকা পড়বে। চিত্রসাংবাদিকদের ব্যাপারটা আরও কঠিন। কারণ, তারা ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা, লেন্স, ল্যাপটপ ইত্যাদি কিনেই চিত্রসাংবাদিকতায় আসেন। তাদের তোলা ছবি সম্পাদক বা চিফ ফটোগ্রাফারের নজরে পড়লে তারা ছবি তোলার ডাক পান। তারপর কাজ ভালো হলে প্রশংসা শুরু হয় – ‘দুর্দান্ত’, ‘ফাটিয়ে দিয়েছো’, ‘তুমি কম্পানির অ্যাসেট’। রাতারাতি এই ফানুসটা চুপসে যায়, তাড়াতাড়ি আমরাও হারিয়ে যাই।
করোনার বাজারে চাকরি যাওয়াটা এখন ভাইরাল। সব কম্পানির মালিকরা ওয়েটিং ফর গোডো নাটকের চরিত্রটির মত বলছেন, ‘কিচ্ছু করার নেই’। আমরা চালাতে পারছি না, লোকবল কমাতে হবে। মালিকের দালালি করা সাংবাদিকরা সবসময়েই বেশ রসেবশে থাকেন। অবশ্য প্রয়োজন ফুরালে তাদের দুরাবস্থা দেখে শেয়াল, কুকুরও কাঁদে। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি ম্যানেজমেন্ট পড়া চালাকচতুর ছেলেমেয়েরা এখন সংবাদমাধ্যমে সাংবাদিকদের চেয়েও বেশি বেতন পান। মালিকের নিত্যনতুন পলিসিতে সায় দেওয়াই এদের কাজ। এরা গামছা পরেও মালিকের দালালি করতে রাজি। তারা কিন্তু দিব্যি টিঁকে থাকেন।
যে সাংবাদিকরা ২০-২৫ বছর ধরে কাগজকে সার্ভিস দিলেন, তাকে দু মাসের বেতন দিয়ে যারা তাড়িয়ে দিচ্ছেন তাদের কাছে আমার একটা জিজ্ঞাসা আছে? এদের কি অন্তত ৫-১০ লাখ টাকার একটা কমপেনসেশন প্যাকেজ দেওয়া যেত না? ম্যানেজমেন্টের নামাবলী গায়ে দিয়ে যারা মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা বেতন পান সেই মেধাবী সাংবাদিকদের কিছুই কি করার নেই! ‘হাল্লা বোল’ আওয়াজটা শুধু কি সরকারের বিরুদ্ধেই উঠবে! একদা সহকর্মী অসহায় সাংবাদিকদের কথা ভাবুন। এদের পরিশ্রম, মেধা, সাহস, নিষ্ঠায় কিন্তু আপনাদের প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড তৈরি করেছে। এরা না থাকলে আপনারা কোথায়! একটা উদাহরণ দিই, যাদের তাড়ালেন তারা না থাকলে কী সরকার বাড়ির কোন ব্র্যান্ড তৈরি হত? পারলে ম্যানেজমেন্টকে বোঝান যাদের ইস্তফা দিতে বলা হচ্ছে, তাদেরকে আমাদের লক্ষাধিক টাকা বেতন থেকে কেটে এককালীন সাহায্য করা হোক।
আপনারাই একদিন এদের মাথায় হাত বুলিয়ে কাজ করিয়েছেন। এদের পরিশ্রমে তৈরি হয়েছে আপনাদের কেরিয়ার। নিজেদের বেতন লক্ষাধিক হলেও সাধারণ সাংবাদিক, চিত্রসাংবাদিকদের বেতন ৪ হাজার থেকে শুরু করে ২৯ হাজারে পৌঁছতে ২০ বছর লেগেছে। সব সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিক বন্ধুদের কাছে আমার আবেদন, আসুন রাতারাতি চাকরি যাওয়া সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিক বন্ধুদের পাশে দাঁড়াই। আওয়াজ তুলি ছাঁটাই সাংবাদিকদের কমপেনসেশন প্যাকেজ দিতেই হবে। সবাই মিলে একটা রুটি ভাগ করে না খেতে শিখলে এই পরিস্থিতিতে আমরা কেউই বাঁচবো না।
মালিকদের ‘হিউম্যান রিসোর্স’ ধ্বংস করছে সংবাদমাধ্যমের প্রকৃত ‘হিউম্যান রিসোর্স’কে। এই অপরাধ একদিন মালিকদেরও স্পর্শ করবে। কিছুদিন পর এই সংবাদমাধ্যমগুলোর দিকে তাকালেই তা বুঝতে পারবেন। কারণ মানুষকে বাদ দিয়ে কিছুই হয় না, সংবাদমাধ্যম তো নয়ই। তা চালাতে ‘হিউম্যান রিসোর্স’ লাগে, ‘ইনহিউম্যান রিসোর্স’ নয়।
অশোক মজুমদার