পার্থ সারথি নন্দী, দেশের সময়: শনিবার সারাটা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি , বারবার দু’হাজার সালের বন্যায় বিদ্ধস্ত হওয়া আমার শহর বনগাঁর সেই দুর্দশার ছবি মনে পড়ছিল।মনে পড়ছিল বনগাঁ মহকুমার হাজার হাজার মানুষ কিভাবে ঘর ছাড়া হয়েছিলেন।মনে পড়ছিল সেই সব দুর্গত মানুষের চোখগুলো,ভয় আর আতঙ্কের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা সহজ সরল মানুষদের কথা।তাই আর না ঘুমিয়ে কাউকে না জানিয়ে ক্যামেরা হাতে বেড়িয়ে পড়লাম রাস্তায়।
বনগাঁ স্টেশন।
এমন রঙ হীন রবিবার বনগাঁ কখনও দেখিনি। এমন নিঃস্তব্ধ ছুটির দিনও হতে পারে, এ শহর কস্মিনকালে ভাবেনি। লকডাউনের পর এমন রবিবারের চেহারা সিনেমাতেও বোধহয় দেখা যায়নি! অবশ্য লকডাউনের পর প্রথম রবিবার তাই–বা লিখছি কেন? এখন তো গত এক সপ্তাহ ধরেই রোজ রবিবার।
বনগাঁ মণীষাঙ্গণ৷
বনগাঁ হাইস্কুল মোড়৷
রায় ব্রিজ ও রাখালদাস সেতুর দু’পাশের রাস্তায় হয়তো এক ঘণ্টা অন্তর একটি গাড়ি কিংবা স্কুটার যাচ্ছে। মাঝে ধীর গতিতে বয়ে চলেছে সকলের প্রিয় ইছামতী নদী৷ বনগাঁ স্টেশন, শহরের ১নং রেল থেকে শুরু করে যশোররোড ধরে এগিয়ে এসে স্টেশন রোড, বাটামোড়,মতিগঞ্জ,’ট’বাজার,নেতাজীমার্কেট, মনীষাঙ্গণ(ত্রিকোণপার্ক) হাসপাতাল কালীবাড়ি, পাইকপাড়া হয়ে পেট্রাপোল সীমান্ত পর্যন্ত গোটা রাস্তাটাই যেন পরিত্যক্ত নগরী। যদিও বাজার এর মধ্যে কিছু কিছু মুদি–দোকানে চাক–ধরা মানুষের ভিড় আছে।
‘ট,’ বাজার ,নিউমার্কেটে কিছু কিছু অংশে মানুষের কেনাকাটার চেনা ছবিও দেখা গেছে। নিয়ম মেনেছেন চকখড়ি দিয়ে কাটা বৃত্তে দাঁড়িয়ে। আবার নিয়ম ভেঙেও পুলিশের ধমক খেয়েছেন অনেকেই।
বনগাঁ পুরভবনের সামনে ‘ট’ বাজার এলাকা।
দিনের পর দিন কর্মহীন, ভাবনাহীন, যাতায়াতহীন হয়ে ঘরে বসে থাকতে থাকতে মনের ভেতর অনেকেরই এক আতঙ্ক–অসুখ দেখা দিয়েছে। অসুখের চেহারা বড় অদ্ভুত! সামান্য হাঁচি, কিংবা কাশি হলেই সন্দেহের চোখে মানুষ মানুষের দিকে তাকাচ্ছে। শুধু তা–ই নয়, বহু মানুষ দিনে ঘুমিয়ে ওঠার পর রাত জেগে টিভি বা সিনেমা দেখছেন। তাঁরাই ভোর থেকে ভাবছেন আজ কীভাবে যাবে।
রোজই তো এক দৃশ্য, এক কাজ। নিত্যনতুন ভাবনা থেকে তাঁরা ঘরে কাটানোর অসম লড়াইয়ে অনেক কিছুই ভাবছেন। কিন্তু, আসলে সব ভাবনাই থমকে যাচ্ছে।
বনগাঁ চাকদহ সড়ক।
রবিবার মানেই আম–বাঙালির কাছে মাংস–ভাত। তারপর খবরের কাগজের পাতা উল্টে রবিবাসরীয় ঘুম। বিকেলে এদিক–ওদিক বেড়াতে যাওয়া। কিংবা শপিং মল, সিনেমা হল ঘুরে সন্ধ্যা কাটানো। লকডাউনের রবিবার অবশ্য সে সমস্ত সুযোগ দেয়নি। রবিবারের সান্ধ্যকালীন বাজারগুলোতেও তেমন কোন ভিড় ছিলনা । বাজার করে ঘরে ঢুকে পড়া, ঘর থেকে বাজার করতে আসা— ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাইরের জগৎ দেখার জন্য বরাদ্দ ২ ঘণ্টার বাঁধাধরা রুটিন।
তারপর? সারা দিনই ঘরে।
লকডাউন শুরুর দিকে কাঁড়ি কাঁড়ি জিনিসপত্র কিনে ঘর বোঝাই করার যে হিড়িক শুরু হয়েছিল, এখন সে প্রবণতা কিছুটা কমেছে। সকালের দিকে সবজিবাজারে ভিড় অবশ্য মোটামুটি ভালই ছিল। ভোর বেলায় বেশ কিছু সবজি বোঝাই গাড়ি এই শহরের উপর দিয়ে গেছে কলকাতার কোলে মার্কেটের দিকে৷ বনগাঁ থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরাই মুলত ছিলেন সেই সব গাড়িতে । বিকেলে অবশ্য ঘরবন্দিই থেকেছে বনগাঁ।
বনগাঁ মিলিটরী রোড।
এখন প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন সংগঠন সহ নেতা নেত্রীরা বিভিন্ন জায়গায় কোথাও চাল–ডাল–কাঁচা আনাজ গরিব মানুষকে দিচ্ছেন নিয়ম করে। কোথাওবা রান্না খাবার দেওয়া হচ্ছে। এই দু’ধরনের সামাজিক কর্মে অনেকে যুক্ত হয়েছেন।
বনগাঁ মতিগঞ্জ।
খেলাধুলো বহুদিন বন্ধ। তাই ফুটবল, ক্রিকেটে মজে থাকা বাঙালি এখন ইউটিউব, নেটফ্লিক্সে দেশি–বিদেশি ছবি দেখে সময় কাটাচ্ছেন। কিন্তু আতঙ্ক ছাড়ছে না। টিভিতে চোখ রেখে করোনা আপডেট দেখে নিচ্ছেন। আপডেট দেখার পরই সেই ভয় তাঁকে ঘিরে ধরছে।
কিন্তু, বেঁচে থাকা নিয়েই বড় ভয়ে আছেন একেবারে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষেরা। সেই ভয় চোখে দেখা যায় না,রাত যত বাড়ে যশোর রোডের প্রায় তিনশো বছরের প্রাচিন গাছের নীচে নি:স্তব্ধতাও ততো বাড়ে,শুনশান আমার শহর বনগাঁর মিষ্টি মানুষগুলো কেমন আছেন জানতে ইচ্ছে করে৷