আমপানের নজিরবিহীন ধ্বংসলীলা,কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তা চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী

0
2107

দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ শেষ কবে এমন ঝড় কলকাতার উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে, অনেকেরই স্মৃতিতেও বিলীন৷ অতীতে, আয়লা, বুলবুল, ফণীর সময়ে মহানগরীতে এর সিকিভাগ ক্ষতি হতেও হয়তো দেখেননি কেউ। কিন্তু বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টা নাগাদ প্রায় ১৩৩ কিলোমিটার গতিতে কলকাতায় রীতিমতো তাণ্ডব চালাল ঘূর্ণিঝড় আমপান। যার ধাক্কায় উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতা, বাইপাস সংলগ্ন পূর্ব কলকাতা সহ গোটা শহরে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে কলকাতায় অন্তত তিন জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। কলকাতায় তালতলা এলাকায় এক ব্যক্তি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন। তা ছাড়া রিজেন্ট পার্ক থানা এলাকায় গাছ পড়ে মৃত্যু হয়েছে মা ও ছেলের। সেই সঙ্গে প্রায় এক হাজার গাছ উপড়ে পড়েছে বা তার অংশ ভেঙে পড়েছে প্রাথমিক হিসাবে মনে করছেন পুলিশ ও পুরসভার কর্তারা। শুধু তাই নয়, বহু জায়গায় বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গিয়েছে। সেইসঙ্গে কেবল টিভির তারও ছিঁড়ে পড়েছে রাস্তায় রাস্তায়। তবে বুধবার রাতে ঝড়ের গতি কমার সঙ্গে সঙ্গেই পুরসভা ও দমকলের কর্মীরা গাছ কেটে রাস্তা পরিষ্কার করার কাজ শুরু করে দিয়েছেন। সেই কাজে তদারকি করেছেন কলকাতা পুরসভার প্রশাসক তথা পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।

বস্তুত বুধবার সকালেই আলিপুর আবহাওয়া দফতর সূত্রে বলা হয়েছিল, ঘূর্ণঝড় আমপান সুন্দরবনে আছড়ে পড়লেও তার নিশানা হতে পারে কলকাতাও। শহরের উপর দিয়ে সর্বোচ্চ ১৩৩কিলোমিটার গতিবেগে ঝড় বয়ে যাবে। তার ফলে কলকাতা তছনছ হতে পারে। কারণ, তাতে গাছ, বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং, বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ঝড়ে কলকাতায় বহু বাড়ির জানালার কাঁচ ভেঙেছে। এ বাড়ির ছাদের জিনিস উড়ে গেছে অন্য বাড়িতে। তা ছাড়া বহুতল আবাসনে জলে ভেসে গেছে অনেক ফ্ল্যাট। অ্যালুমিনিয়াম চ্যানেলের জানালা দিয়ে হুহু করে ঘরে ঢুকে পড়েছে জল।

আবহাওয়া দফতরের এই পূর্বাভাস জানার পর, পুরসভা ও পুলিশের তরফে এদিন কলকাতাবাসীকে বারবার সতর্ক করে দেওয়া হয় যে দুপুরের পর কেউ যেন রাস্তায় না বেরোন। মাইকে করে লাগাতার প্রচার চালিয়ে যায় পুলিশ। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে কলকাতার বেশ কিছু উড়ালপুল বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিপজ্জনক বাড়ি থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে তাঁদের নিকটবর্তী স্কুল, কমিউনিটি হলে রাখার ব্যবস্থা করে প্রশাসন। অনেককে তাঁদের আত্মীয়দের বাড়িতেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তা ছাড়া ফুটপাতবাসীদেরও নিকটবর্তী স্কুল ও কমিউনিটি হলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা কারণেই অপ্রীতিকর ঘটনা বিশেষ ঘটেনি। কিন্তু গাছ পড়ে বিপত্তির একশেষ হয়েছে। বালিগঞ্জ, সাদার্ন অ্যাভেনিউ, গড়িয়াহাট, নিউ আলিপুর, শেক্সপীয়র সরণী, যাদবপুর, একবালপুর, চেতলা, টালিগঞ্জ, হেস্টিংস, উল্টোডাঙা, বেনিয়াপুকুর, হাজরা, ভবানীপুর সহ বহু এলাকায় গাছ উপড়ে গিয়ে বা ডাল ভেঙে লণ্ডভণ্ড অবস্থা হয়েছে। কসবায় ল্যাম্পপোস্ট ভেঙে রাস্তার উপর আছড়ে পড়ে। ফলে বিদ্যুতের তার গাছ মায় মিলে রাসবিহারী কানেক্টরই প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। একই ভাবে ট্রামের তার ছিঁড়ে পড়েছে কলেজ স্ট্রিট এলাকায়। উড়ে গিয়েছে একাধিক মেট্রো স্টেশনের শেড।

পুলিশ ও পুরসভা সূত্রে বলা হচ্ছে, গাছ কেটে বৃহস্পতিবার বিকেলের মধ্যে কলকাতায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ফেরানোর জন্য কাজ চলছে। তা ছাড়া বিদ্যুতের সংযোগ মেরামতের কাজ শুরু করে দিয়েছে সিইএসসিও। পুরসভার এক কর্তা বুধবার রাতে বলেন, এমনিতে করোনা সংক্রমণের কারণে কলকাতায় যানবাহণের চাপ কম। নইলে সাধারণ পরিস্থিতি থাকলে অন্তত দুদিন বহু মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হত।

আমপানের মোকাবিলায় নবান্নেই থেকেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় যেভাবে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে আমপান ,তা নিয়ে বলতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার বলেন, ‘এলাকার পর এলাকা ধ্বংস, তিন-চারদিন সময় লাগবে রিপোর্ট পেতে। ৫ লক্ষ মানুষকে সরিয়েছিলাম,এতটা ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠল এই ঝড়!’

তাঁর কথায়, ‘বিভিন্ন জেলায় মানুষদের নিরাপদে স্থানে সরানো হয়েছিল। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। আমরা সিরিয়াসলি যদি না নিতাম, ৫ লক্ষ মানুষকে না সরালে কত মানুষ মারা যেতেন, জানি না। নবান্নেরও প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। আমার রুমে ঢুকতে পারিনি। কাঁচ ভেঙে গেছে। এখানে এই অবস্থা হলে সারা বাংলায় যে তাণ্ডব হয়েছে, তার ক্ষতি তো বিপুল।’

তবে, তিনি জানান, ইতোমধ্যেই নবান্নের কাছে দশ-বারো জনের মৃত্যুর খবর এসে পৌঁছেছে। তাঁর কথায়, ‘মৃত্যুর সংখ্যা হয়ত কমানো গিয়েছে, কিন্তু সব মিলিয়ে কঠিন পরিস্থিতি বাংলার জন্যে। ওডিশা বেঁচে গিয়েছে। দীঘার ক্ষতি যতটা ভেবেছিলাম, তা হয়নি। কিন্তু উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা ধ্বংস হয়ে গেছে। রাস্তা, ঘরবাড়ি, ব্রিজ সব ভেঙে পড়েছে। এখনও সব খবর পাইনি।’

এদিন আক্ষেপের সুরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বেশিরভাগ গাছ ও বাড়ি ভেঙে মারা গিয়েছেন। অনেকে আহত হয়েছেন। বিদ্যুৎ নেই। জল নেই। পুকুরগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। দিকেদিকে ধ্বংসের চিহ্ন। বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আস্তেআস্তে হয়ত কমবে। ধানের ক্ষেত থেকে শুরু করে সব নষ্ট হয়ে গেছে। খুব খারাপ লাগছে। বুলবুলের সময় মেরামত করেছিলাম। আজ যেটা হল, সেটা ধ্বংস। করোনার জন্যে রাজ্যের আয় বন্ধ। আজকের ক্ষতি লক্ষ কোটিতে যাবে কিনা, দেখতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা সকলেই কাজ করব। বাংলা পারবে। পারতেই হবে।’একের পর এক জেলা থেকে বিপর্যয়ের খবর শুনে বুধবার রাতে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীকে দৃশ্যত বিধ্বস্ত দেখায়। সমগ্র দেশবাসীর কাছে সাহায্যের জন্য আর্জি জানান মমতা। তিনি বলেন, ‘‘রাজনৈতিক ভাবে এই ঝড়কে না দেখে মানবিকতার দিক দিয়ে দেখুন। এখন রাজনীতি দূরে থাক। বাংলাকে ধ্বংস থেকে উন্নয়নের পথে ফের দাঁড় করাতে হবে। সবার সহযোগিতা চাইছি।’’ রাজনৈতিক সূত্রের খবর, রাজ্যের পরিস্থিতি জানতে মমতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন সনিয়া গাঁধী।

ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত দক্ষিণবঙ্গে ত্রাণ ও পুনর্গঠনের কাজে কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তা চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। 

মুখ্যমন্ত্রী জানান, সব হিসেব উল্টে গিয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘কারও ভবিষ্যদ্বাণী মিলল না। পুরোটা বাংলার উপর দিয়ে গেল। করোনার জন্য অর্থনীতির অবস্থা শেষ। তার পর এই দুর্যোগ। কোনও রোজগার নেই। পুনর্গঠন করতে অনেক টাকা লাগবে।’’ বিপর্যয়ের বিবরণ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘এলাকার পর এলাকা ধ্বংস। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। প্রশাসন ৫ লক্ষ মানুষকে সরাতে পেরেছে। ১৭৩৭ সালে এমন ভয়ঙ্কর ঝড় হয়েছিল। ওয়ার রুমে বসে আছি আমি। নবান্নে আমার অফিস কাঁপছে। একটা কঠিন পরিস্থিতির যুদ্ধকালীন মোকাবিলা করলাম। মাঝরাত পর্যন্ত হয়তো ঝঞ্ঝা চলবে। নন্দীগ্রাম, রামনগর এলাকায় বড় ক্ষতি। দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনা প্রায় ধ্বংস ঝড়ের দাপটে। মোট ক্ষতি এখনও হিসেব করা যায়নি। অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ নেই, জল নেই। পাথরপ্রতিমা, নামখানা, কাকদ্বীপ, কুলতলি, বারুইপুর, সোনারপুর— সব জায়গায় ধ্বংসের ছবি। রাজারহাট, হাসনাবাদ, সন্দেশখালি, গোসাবা, হাবড়া, সব জায়গাই বিপর্যস্ত।’’

এদিন তিনি রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রমের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। 

Previous articleআমপানের তান্ডবে বাগানের সব আম ধূলিসাৎ,লন্ড ভন্ড যশোর রোড
Next articleআমপানের তাণ্ডবে রাজ্যে মৃত অন্তত ১২, দুই চব্বিশ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল গাছে-তারে এখনও অবরুদ্ধ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here