দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ কদিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, এই ঝড় আয়লার থেকেও ভয়ঙ্কর হতে পারে৷রাতের অন্ধকারেই আঁচ পাওয়া গিয়েছিল কতটা মারাত্মক হতে চলেছে আমপান(প্রকৃত উচ্চারণে উম পুন)-এর রাক্ষুসে কামড়। সকাল হতেই সামনে এল গোটা রাজ্য জুড়ে দানবীয় সাইক্লোনের রেখে যাওয়া দগদগে ক্ষত! দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন জেলা থেকে আসতে থাকে একের পর এক মৃত্যুর খবর, ক্ষয়ক্ষতির খবর। কিন্তু সবটাই খণ্ডচিত্র। নবান্ন সূত্রে খবর, গোটা রাজ্যের খুব অল্প অংশের ক্ষয়ক্ষতির ছবিই সামনে এসেছে এখনও পর্যন্ত। কারণ, বহু এলাকাই এখনও পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। বিদ্যুৎ নেই। টেলি যোগাযোগ ব্যাবস্থাও সম্পূর্ণ ভাবে বিপর্যস্ত।
বুধবার দুপুর থেকে রাত প্রায় ১২ টা পর্যন্ত সেই ঝড় যখন পশ্চিমবঙ্গের উপকূল অঞ্চল এবং কলকাতা, হাওড়া সহ সীমান্ত শহর বনগাঁয় তুমুল তাণ্ডব চালিয়ে কিছুটা গতি কমাল, তখন নবান্নের অলিন্দে মুখ্যমন্ত্রীর চোখে মুখে উৎকন্ঠার ছাপ পরিষ্কার। অতন্দ্র প্রহরীর মতো প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের নিয়ে কন্ট্রোল রুমে বসেছিলেন তিনি। বললেন, “সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। দুই চব্বিশ পরগনা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। কত ক্ষতি হয়েছে আন্দাজ করা যাচ্ছে না।” মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, এখনও পর্যন্ত ১০-১২ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে খবর পেয়েছি।
কলকাতায় তিন জন, পূর্ব মেদিনীপুরে তিন জন, উত্তর চব্বিশ পরগনা এবং হাওড়ায় এক জনের মৃত্যুর খবর সুনির্দিষ্ট ভাবে জানা গিয়েছে। হাওড়ার মৃত কিশোরী লক্ষ্মী কুমার সাউয়ের বয়স মাত্র ১৩ বছর। বাড়ি ভেঙে চাপা পড়ে তার মৃত্যু হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরের ভূপতিনগরে বাড়ি ভেঙে এক মহিলার মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। এ ছাড়া মুগবেড়িয়া ও মহম্মদপুরে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে।
উত্তর চব্বিশ পরগনার মিনাখাঁয় ৫৬ বছরের এক প্রৌঢ় নুরজাহান বেওয়া-ও ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা গেছে। আর কলকাতায় তালতলা এলাকায় এক ব্যক্তি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন। তা ছাড়া রিজেন্ট পার্ক থানা এলাকায় গাছ পড়ে মৃত্যু হয়েছে মা ও ছেলের।
প্রশাসন ও পুলিশের তরফে বলা হচ্ছে, হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা কত তা জানতে কাল বিকেল হয়ে যেতে পারে। কারণ, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ও উত্তর চব্বিশ পরগনার বহু এলাকার সঙ্গে সড়কপথে যোগাোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থাও প্রায় বিচ্ছিন্ন। প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের মে মাসে আয়লায় মৃত্যু হয়েছিল ৯৪ জনের। সে বার হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা জানতে দু’দিন লেগে গিয়েছিল।
কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের ডিরেক্টর মৃত্যঞ্জয় মহাপাত্র রাতে জানিয়েছেন, আমপানের ল্যান্ডফলের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল বুধবার দুপুর আড়াইটে নাগাদ। তার পর বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ঘূর্ণিঝড়ের অক্ষ তথা তার চোখের অর্ধেকটা সুন্দরবনের স্থলভাগে ঢুকে পড়ে। তার পর সন্ধে সাড়ে ৬ টা নাগাদ তা পুরোপুরি আছড়ে পড়ে সুন্দরবনে। সেই সময় হাওয়ার গতিবেগ ছিল সর্বোচ্চ ঘন্টায় ১৮৫ কিলোমিটার। ঝড়ের তীব্রতা তখন বাড়তে থাকে কলকাতাতেও। সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টা নাগাদ কলকাতায় ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১৩০ কিলোমিটার। হালফিলে যা কখনও দেখেনি এই মহানগরী।
পরে আমপান গতি কমিয়ে উত্তর-উত্তর পশ্চিমের দিকে রওনা হয়। ফলে তখন উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়া,বনগাঁ , নদিয়া, পূর্ব বর্ধমান এবং মুর্শিদাবাদে ঝড়ের গতি ছিল ঘন্টায় ১১০ কিলোমিটার। তার পর তা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
এখন উদ্বেগের বিষয় হল, ক্ষয়ক্ষতি কোথায় কতটা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোরে প্রশাসনের সূত্রে শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগর, কাকদ্বীপ, নামখানা, বাসন্তী, পাথর প্রতিমা সহ সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় অন্তত দশ হাজার কাঁচা বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্যানিং, ডায়মন্ডহারবার, বারুইপুর মহকুমার বহু এলাকায় রাস্তায় বড় গাছ পড়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। একই অবস্থা উত্তর চব্বিশ পরগনাতেও। সেখানে হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ, ধামাখালি, হাড়োয়া, সন্দেশখালি,হাবড়া, বনগাঁতেও কয়েক হাজার কাঁচা ঘর ভেঙে পড়েছে। মাঠে ফসলের ক্ষেত মিশে গিয়েছে মাটিতেই।তা ছাড়া বনগাঁ,ব্যারাকপুর ও বসিরহাট মহকুমার বহু এলাকা তছনছ হয়ে গিয়েছে। দুই চব্বিশ পরগনাতেই বহু জায়গায় বিদ্যুতের পোল উপড়ে গিয়েছে।
তা ছাড়া দুই চব্বিশ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুর মিলিয়ে মোট ১৫ টি নদী বাঁধ ভেঙেছে বলে সেচ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে। এর মধ্যে সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায়। সেখানে ৯টি নদী বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। উত্তর চব্বিশ পরগনায় ভেঙেছে ৫ টি এবং পূর্ব মেদিনীপুরে ১ টি। এ ছাড়া বুড়িগঙ্গার উপরে কচুবেড়িয়ায় ও নামখানার নারায়ণপুরে দুটি জেটি ভেঙেছে বলেও জানা গিয়েছে।
অতীতে আয়লার পরে বামফ্রন্ট সরকার জানিয়েছিল, ঘূর্ণিঝড়ে কমবেশি ৬ লক্ষ বাড়ি পুরোপুরি বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৬ লক্ষ। উমফানের তাণ্ডবের ফলে ক্ষয়ক্ষতি তার বেশি কিনা তা আগামী অন্তত সাত-দশ দিন ধরে পর্যালোচনা না করে প্রাথমিক আন্দাজটাও পাওয়া যাবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
বুধবার রাতে নবান্ন থেকে বেরনোর সময় মুখ্যমন্ত্রীর কথাতেও উদ্বেগ ধরা পড়ে। তিনি বলেন, “ভাবতেই পারছি না পুনর্বাসনের কাজটা কী ভাবে করব।” বহু বাড়ি, বিঘের পর বিঘে ধানক্ষেত, অসংখ্য বিদ্যুতের খুঁটি লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। নষ্ট হয়ে গিয়েছে বহু পুকুর। পর্যাপ্ত জল নেই”।
তবে সেচ মন্ত্রী জানিয়েছেন, নদী বাঁধ নির্মাণের কাজ থেকেই জোর কদমে শুরু হয়ে যাবে। ঘূর্ণিঝড়ের আগেই থেকেই দফতর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। প্রভাবিত এলাকায় দফতরের অফিসার ও কর্মীরা রয়েছেন। তাঁরা তদারকি করে জরুরি ভিত্তিতে কাজ শুরু করে দেবেন।
অন্য দিকে খবর পাওয়া গিয়েছে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকায় নদীবাঁধ ভেঙে ভেসে গিয়েছে একের পর এক এলাকা। কিন্তু সেখানকার প্রকৃত ছবি এখনও সামনে আসেনি। এখনও কার্যত বিচ্ছিন্ন ওই দুই জেলার অনেকটা অংশ। জানা যায়নি সেখানকার হতাহতের খবরও। খুব প্রাথমিক ভাবে রাজ্যের উপকূলবর্তী তিন জেলা প্রশাসনের হিসাব, হাজার হাজার কাঁচা বাড়ি ভেঙে গিয়েছে। নিরাশ্রয় হয়েছেন লাখো লাখো মানুষ। ধ্বংস হয়ে গিয়েছে চাষের মাঠ, পানের বরোজ, সব্জির খেত। বুধবারই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। সকালের ছবিটা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে বলে প্রশাসনের কর্তাদের দাবি। পুরো ছবি পেতে আরও অনেকটা সময় লাগবে বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। তবে আয়লার বীভৎসতাকেও আমপান ছাপিয়ে গিয়েছে তা নিয়ে তাঁদের সংশয় নেই।