দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে যেমন হয়, কয়েক ঘণ্টার ব্যাকরুম ড্রামা যেন তার থেকেও রোমহর্ষক। ক্রিকেট মাঠ ও রাজনীতির বারান্দা তখন মিলেমিশে একাকার। বলা যেতে পারে সীমিত ওভারের খেলার পাওয়ার প্লে-র মতোই সেই মুহূর্তে শুরু হয়ে যায় পাওয়ার পলিটিক্স।
সৌরভকে প্রায় প্যাভিলিয়নে পাঠিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করে প্রাক্তন বোর্ড প্রেসিডেন্ট নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন যখন তাঁর পছন্দের মোহরা ব্রিজেশ পটেলকে শীর্ষ প্রশাসক পদে বসানোর সমস্ত ফিল্ডার সাজিয়ে ফেলেছেন, তখন রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ এক নতুন তৎপরতা শুরু হয়ে যায় দিল্লিতে।
মুম্বইয়ে ভোটের প্রচার সেরে তার কিছুক্ষণ আগেই দিল্লি পৌঁছেছেন সর্বভারতীয় রাজনীতিতে এই মুহূর্তে অমিতশক্তিধারী নেতাটি — কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপি সভাপতি তথা গুজরাত ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট অমিত শাহ। বোর্ড গঠন নিয়ে তাঁর ব্যক্তি স্বার্থও ভাল রকম জড়িয়ে। কারণ, বোর্ডের সচিব হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন অমিত পুত্র জয় শাহ।
জানা গিয়েছে, এর দু-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই অমিতের ফোন যায় উত্তর-পূর্বে তাঁর অন্যতম আস্থাভাজন সেনাপতি তথা অসমের মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার কাছে। উত্তর-পূর্ব থেকে বোর্ডের ভোটাভুটিতে মহার্ঘ আটটি ভোটের উপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে হিমন্তের।
বোর্ড ও বিজেপি-র শীর্ষ সূত্রে খবর, অমিত শাহ হিমন্তকে ফোনে বলেন, শ্রীনিকে বলে দাও কথা অনেক হয়েছে, আর নয়। বোর্ড সভাপতি করতে হবে সৌরভকেই। কর্তার যেমন আজ্ঞা। হিমন্ত তক্ষুণি ফোনে শ্রীনিবাসনকে জানিয়ে দেন, ব্রিজেশ পটেলকে বোর্ড সভাপতি করা যাবে না। সৌরভই প্রেসিডেন্ট হবেন। আর কোনও যদি কিন্তু নয়।
প্রসঙ্গত, শ্রীনিবাসনের জামাই গুরুনাথ মইয়াপ্পন আইপিএল টুর্নামেন্ট চলাকালীন বেটিং কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত। তার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি।
জানা গিয়েছে, শ্রীনির পাশাপাশি ফোন যায় সৌরভের কাছেও। তারপর মধ্যরাতে বোর্ড সভাপতি পদের জন্য মনোনয়ন পেশ করেন মহারাজ।
প্রশ্ন উঠতেই পারে কেন সৌরভকেই বোর্ড প্রেসিডেন্ট করার ব্যাপারে সমস্ত ওজন ও শক্তি ঢেলে দিলেন অমিত শাহ?
এর ব্যাখ্যা অমিত কাউকে দিয়েছেন বলে জানা যায়নি। তবে অমিতের ঘনিষ্ঠরা মনে করছেন, এর স্পষ্ট দুটি কারণ থাকতে পারে। এক, জয় শাহ বোর্ডের সচিব হওয়ায় কিছুটা সমালোচনা হতে পারে আশঙ্কা ছিলই। সেই সঙ্গে ব্রিজেশ পটেল সভাপতি হলে, নতুন বোর্ড ও তার কমিটি নিয়ে কাটাছেঁড়া শুরু হয়ে যেতে পারত। তুলনায় সৌরভকে সভাপতি করলে ইতিবাচক বার্তা যাবে এবং গোটা আলোটাই শুষে নেবেন মহারাজ। জয় শাহর ব্যাপারে খুব বেশি আলোচনা তখন হবে না। দ্বিতীয়ত, এর মাধ্যমে বাংলার রাজনীতিতেও একটা বার্তা দেওয়া যাবে। এটুকু অন্তত বোঝানো যাবে বিজেপি বাঙালি আবেগকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে। ভবিষ্যতে প্রয়োজনে সৌরভকে কোনও প্রশাসনিক পদের জন্যও ভাবা যেতে পারে।
বলে রাখা ভাল, বিসিসিআইয়ের ক্ষমতা দখল নিয়ে এই পাওয়ার পলিটিক্স নতুন নয়। শরদ পওয়ারকে বোর্ড সভাপতি করার সময় দশ নম্বর জনপথ তথা সনিয়া গান্ধীর বাসভবন সেই রাজনীতির এপিসেন্টার হয়ে উঠেছিল। সনিয়ার রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেল তখন অধুনা হিমন্তের ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেই ট্র্যাডিশনই সমানে চলছে।
অমিত ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, এই রাজনীতির বাইরে মহারাজের মেজাজ, তাঁর ইমেজ, তাঁর ক্রিকেটীয় কেরিয়ারের গুডউইল সবই তাঁর অ্যাডভান্টেজ হিসাবে এ যাত্রায় অনুঘটকের কাজ করেছে। নইলে অমিত শাহেরও তো সমস্যা হতো।
বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটুকুই বাকি। মঙ্গলবার বিকেলে শহরে ফিরলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। বিমানবন্দরে সৌরভকে নিয়ে ছিল উন্মাদনা। সৌরভ অনুগামীরা হাজির হয়েছিলেন বিমানবন্দরে। এরপর তিনি সোজা চলে যান সিএবিতে।
সৌরভের গাড়ি যখন সিএবিতে এসে পৌঁছাল। উন্মাদনা অন্য মাত্রা নিল। ক্যামেরার ঝলকানি। মিডিয়ার হামলে পড়া। বাদ গেল না কিছুই। উৎসাহী জনতা তো আছেনই। বেশ কিছুক্ষণ গাড়িতেই বসে থাকতে হল বোর্ডের নতুন সভাপতিকে। তারপর সমর্থকদের জয়ধ্বনির মাঝেই ঢুকে গেলেন সিএবিতে।
সিএবিতে সৌরভের জন্য রাখা হয়েছে বিশালাকার কেক। সিএবিতে ঢোকার মুখে হল পুষ্পবৃষ্টি। আতসবাজি পুড়িয়ে সৌরভকে বরণ করা হয়। বোর্ডের নতুন সভাপতিকে একপ্রস্থ সংবর্ধনা দেওয়া হল সিএবিতে। এই উন্মাদনার মাঝেই নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন মহারাজ। বলেছেন, ‘অনেক অভিনন্দন।
অভিজিৎবাবুর কৃতিত্বে বাঙালি হিসেবে গর্ব হচ্ছে।’ এরপরই চলে যান ক্রিকেটীয় প্রসঙ্গে। বলে দেন, ‘আগামী কয়েকটা মাস পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। টিম ইন্ডিয়া খুব ভাল খেলছে। তা যেন বজায় থাকে, সেদিকে নজর রাখতে হবে।’ আগামীদিনে কী রাজনীতিতে আসছেন? তেমন কোনও পরিকল্পনা যে এখন নেই তা স্পষ্ট করে দিলেন সৌরভ। বললেন, ‘রাজনীতি নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি।