দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ পুজো কমিটিকে রাজ্য সরকারের অনুদান দেওয়া নিয়ে মামলা হয়েছিল হাইকোর্টে। সেই মামলার শুনানিতে বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের একাধিক প্রশ্নের মুখে পড়তে হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারকে। আদালত সরাসরি প্রশ্ন তুলে দিল, পুজো কমিটিগুলোকে টাকা দেওয়ার পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই তো!
আর্থিক সঙ্কটের মধ্যেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, পুজো কমিটিগুলিকে এ বছর পঞ্চাশ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে। গত বছর রাজ্যের তরফে প্রতিটি কমিটিকে ২৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়েছিল। আর মহিলা পরিচালিত কমিটিগুলি পেয়েছিল ৩০ হাজার টাকা করে অনুদান। এবার তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫০ হাজার। শুধু তাই নয়, এ বছর বিদ্যুতের খরচে প্রতিটি পুজো কমিটি ৫০ শতাংশ ছাড় পাবে। CESC এবং রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা- উভয়ই এই ছাড় দেবে বলেও ঘোষণা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়েই হাইকোর্টে মামলা দায়ের করছিলেন সিটু নেতা সৌরভ দত্ত। পুজো কমিটিগুলিকে ৫০ হাজার টাকা সাহায্য ও পুরোহিতদের ভাতা নিয়ে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিলেন তিনি। আর সেই মামলার প্রেক্ষিতেই এবার হাইকোর্টের কড়া প্রশ্নের মুখে পড়তে হল রাজ্য সরকারকে। বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, ‘অনুদান কি শুধু দুর্গাপুজোতেই দেয় সরকার? না কি অন্য উৎসবেও দেওয়া হয়? ঈদেও কি দেওয়া হয়েছিল?’
আরও কড়া পর্যবেক্ষণ করে হাইকোর্ট প্রশ্ন তোলে, ‘দুর্গাপুজো নিয়ে আমরা সকলেই গর্বিত। কিন্তু তাই বলে কি যেমন খুশি টাকা দেওয়া যায়? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কি এই ভেদাভেদ করা যায়?’ রাজ্যের তরফে বলার চেষ্টা করা হয়, করোনা মহামারীর কারণে পুজো কমিটিগুলিকে এই টাকা মাস্ক, স্যানিটাইজার কিনতে দেওয়া হচ্ছে। সেই জবাবের প্রেক্ষিতেও বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা (সরকার )বলছেন যে এই টাকা দেওয়া হচ্ছে মাস্ক-স্যানিটাইজার কেনার জন্য। কিন্তু এটা তো সরকার নিজেই কেন্দ্রীয়ভাবে কিনে করতে পারত। তাতে খরচ কম হত।’
সেইসঙ্গে করোনা-কালে দেদার সর্বজনীন পুজোর অনুমতি দেওয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে আদালত। বিচারপতির কথায়, ‘যেখানে সংক্রমণের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনও বন্ধ সেখানে পুজোর অনুমতি কিভাবে দিলেন? কী-কী সুরক্ষা বিধি মেনে চলছেন আপনারা। ভিড় নিয়ন্ত্রণের ব্লু-প্রিন্ট কী? আর সব কাজ পুলিশ করলে ক্লাবকে টাকা দেওয়ার কী যুক্তি?’
স্বাভাবিক কারণেই হাইকোর্টে পুজোর অনুদান-অনুমতি নিয়ে বেশ কিছুটা ব্যাকফুটেই যেতে হল সরকারকে। এ নিয়ে তৃণমূল মহাসচিব তথা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘এটা বিচারাধীন বিষয় তাই এই নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না। দুর্গাপুজো শুধু বাঙালির উৎসব নয়, জাতীয় উৎসব। সমস্ত স্বাস্থ্য বিধি মেনেই দুর্গাপুজো হবে। এই বিষয়ে সরকার সচেতন রয়েছে। ক্লাবগুলো সচেতন রয়েছে। তাঁরা পুজো করছে তাঁরা সচেতন রয়েছে। পুজোয় যাতে সংক্রমণ না ছড়ায়, তার জন্যে পুলিশ, স্বাস্থ্য দফতর, নবান্ন সজাগ রয়েছে। উৎসব চলবে। করোনাও থাকবে। সচেতনতার মধ্যে দিয়েই পুজো হবে।’
অপরদিকে, করোনাকালে বারোয়ারি দুর্গাপুজোর উৎসব বন্ধে বুধবারই হাইকোর্টে আরেকটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে। পুজো চলুক, কিন্তু করোনা আবহে উৎসব বন্ধ হোক–এই আর্জিতে অজয় দে নামে অবসরপ্রাপ্ত এক সিইএসসি কর্মী মামলা দায়ের করেছেন। তাঁর বক্তব্য, হাইকোর্ট হস্তক্ষেপ না করলে দুর্গাপুজোর পরে করোনা সংক্রমণ ভয়ঙ্কর আকার নেবে। মামলাকারীর আইনজীবী সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘করোনা আবহে ও মহামারীর মধ্যে মহারাষ্ট্রে গণেশ পুজোর মিছিল বন্ধ করা হয়েছে।
একই কারণে মহরমের মিছিলও বন্ধ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। আবার এই অবস্থার মধ্যেই কেরলে ওনাম উৎসবে বিধি না মানায় কী হাল হয়েছে, সবাই জানেন। বারোয়ারি পুজোয় জমায়েত বন্ধ না হলে বড় বিপদ হবে বলে আশঙ্কায় আদালতের হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে।’ সম্ভবত বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চে শুক্রবার মামলাটির শুনানি হবে।
মামলার বিষয়ে বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘আমরা পুজো বন্ধের পক্ষে নই। তবে রাজ্য সরকারের উচিত ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা। ভিড় থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা।’ তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘মামলা যে কেউ করতে পারেন। কিন্তু রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই সংক্রমণ ঠেকিয়ে দুর্গোৎসবের যাবতীয় ব্যবস্থা করেছে।’ তবে, আজকের শুনানির পর এই মামলাতেও সরকারকে যে ফের প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে, তা বলাই বাহুল্য।
এদিন শুনানিতে রাজ্য সরকারের উদ্দেশে যে যে প্রশ্ন করেছেন বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় সেগুলি এক নজরে:
১) সরকার কি শুধু দুর্গাপুজোতেই অনুদান দেয়? নাকি অন্য উৎসবেও দেওয়া হয়? ইদেও কি দেওয়া হয়েছিল? দুর্গাপুজো নিয়ে আমরাও গর্বিত, কিন্তু তাই বলে কি যেভাবে ইচ্ছা টাকা দেওয়া যায়? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কি এই ভেদাভেদ করা যায়?
২) আপনারা (রাজ্য সরকার) বলছেন যে এই টাকা দেওয়া হচ্ছে মাস্ক, স্যানিটাইজার কেনার জন্য। কিন্তু এগুলো তো সরকার নিজেই কেন্দ্রীয়ভাবে কিনে দিতে পারত। তাতে খরচ অনেক কম হত।
৩) যেখানে করোনা সংক্রমণের জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনও বন্ধ রয়েছে, সেখানে পুজোর অনুমতি কীভাবে দিল সরকার?
৪) কী কী সুরক্ষা বিধি মেনে চলছে সরকার?
৫) ভিড় নিয়ন্ত্রণের কী ব্লু-প্রিন্ট করা হয়েছে?
৬) সব কাজ যদি পুলিশ করে তাহলে পুজো কমিটিগুলোকে টাকা দেওয়ার কী যুক্তি? এর পিছনে কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই তো?
আগামী কাল হাইকোর্টে ফের রয়েছে এই মামলার শুনানি। এখন দেখার হাইকোর্টের প্রশ্নের জবাবে রাজ্যের তরফে কী বলা হয়।