প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, আমাদের প্রণবদা’র মৃত্যু সংবাদ পেয়ে টিভি দেখছিলাম। মনে পড়ছিল আমার চিত্রসাংবাদিক জীবনের নানা ঘটনার কথা। সে এক ইতিহাস। অফিস থেকে ফিরে নিবেদিতাও তড়িঘড়ি চা নিয়ে বসে পড়লো টিভির সামনে। নিবেদিতার মুখে প্রণবদা’র ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘটনার অনেকটাই শোনা। টিভি দেখতে দেখতে বারবার সে বলছিল, তার ‘কাকু-কাকিমার’ কথা। সেদিন তার মুখে অনেক নতুন কথাও শুনলাম। ওকে বললাম, ওদের নিয়ে একটা লেখা দাওনা। সে কিছুতেই রাজি নয়। বললো, সব কথা মানুষকে জানাতে হবে? ‘এই করোনার সময় বুড়োদের এ একটা অভ্যাস হয়েছে, পারিবারিক কথাও ফেসবুকে লিখে ফেলছে।’ আমি বললাম, খারাপ কি? লকডাউনে করোনার মৃত্যুভয়ে মানুষ তার নিজের কথা বলছে। আজ সকালে অফিস যাওয়ার আগে নিবেদিতা এই লেখাটা দিল।

মনে পড়ে সেই সব দিন…

ক্যাপ্টেন নিবেদিতা গাঙ্গুলি

কাকু আর নেই, মনটা খারাপ লাগছে। কাকিমা আগেই চলে গেছে। আপনাদের কাছে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি, ফার্স্ট লেডি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণবদা এরকম কত পরিচয় তাঁর, আমার কাছে শুধুই কাকু আর কাকিমা। এঁরা এমনকি আমার নিবেদিতা নামটাও জানতেন না। নুপুর (আমার ডাকনাম) বলেই ডাকতেন।

বাগনানের বাইনান গ্রামে বাবা অসিত ও জ্যাঠা অমল গাঙ্গুলির সূত্র ধরে আমি কাকু-কাকিমাকে চিনতাম। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জন্মানোর পরেই আমার মা মনীষা গাঙ্গুলি অজ্ঞাত কারণে মারা যায়, আমার বয়স তখন মাত্র ১১দিন। মা’কে লিফটের কাছে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এর কোন কারণ ডাক্তার, সুপারিন্টেনডেন্ট, নার্সদের জানা ছিলনা। শোনা কথা, মাঝরাতে পেটে প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হওয়ার পর একজন সিসটার ইনজেকশন দেয়। ভোরে লিফটের কাছে মায়ের মৃতদেহ পড়েছিল। সেই সময় বিভিন্ন কাগজ ও রাজনৈতিক দল এই ঘটনার প্রতিবাদে মুখর হয়েছিল। সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছিল এই খবর। তারপর তদন্ত আর তদন্ত, শেষ অবধি কিছুই হলো না। সাধারণ মানুষের আজও অনেক সময় একই অভিজ্ঞতা হয়।

কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে বাবা-জ্যেঠু-কাকা সবাই বাইনান গ্রাম ছাড়া, কে নিয়ে যাবে আমায়? হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাওয়ার কোন লোক ছিলনা। আমার অবিবাহিত মাসি উৎসা ব্যানার্জি থাকতেন কদমতলায় ব্যাটরা থানার পিছনে, এটাই আমার মামার বাড়ি। এখানেই আমাকে নিয়ে আসা হয়। এই মাসি এখনও আমার মায়ের অভাব পূরণ করে চলেছেন। মামার বাড়ির ঠিক পিছনে ভাড়া থাকতেন কাকু (প্রণবদা) আর কাকিমা (শুভ্রা)। ছোটবেলা থেকেই এই বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল, কাকু-কাকিমাও আমাকে খুব স্নেহ করতেন।

আমার ছোটমাসি মধুছন্দা’র সঙ্গে পরবর্তীকালে কবি সাহিত্যিক সুব্রত রুদ্র’র বিয়ে হয়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই বিয়ের প্রধান সাক্ষী। যাইহোক আমার মাসি মধুছন্দা ও কাকিমা শুভ্রা মুখার্জি ‘নৃত্যম’ এ সাগর সেনের কাছে গান শিখতে যেতেন। যতদূর মনে পড়ে কাকু প্রণব মুখার্জি তখন উলুবেড়িয়া কলেজে পড়াতেন। খুব কম কথা বলতেন। কলেজে রাজনীতি নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতেন যে আমরা কেউই কাকুর নাগাল পেতাম না। মাঝে মাঝে তাঁর কাছ থেকে লজেন্স, ছড়ার বই উপহার পেতাম। আমার জ্যেঠু অমল গাঙ্গুলি তখন হাওড়া-হুগলি জেলার অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম পার্টি মেম্বার ছিলেন। পরে তিনি বাগনানের বিধায়ক হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে পার্টির সঙ্গে মতের অমিল হওয়ায় তিনি দল ছেড়ে দেন। শোনা কথা, উলুবেড়িয়ার এক জনসভায় প্রয়াত শ্রদ্ধেয় জ্যোতি বসুর উপস্থিতিতে জ্যেঠু দল ছাড়ার কথা ঘোষণা করেন।

ওই সময় কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে দেওয়া মানে সেই ব্যক্তির খতম তালিকায় চলে যাওয়া। জ্যেঠুর মুখে কমিউনিস্ট পার্টির আভ্যন্তরীণ বহু বিষয় আমি শুনেছি। অমল গাঙ্গুলির লেখা ‘সূর্য সন্ধানে’ বইটিতে সাধারণ মানুষের না জানা কমিউনিস্ট পার্টির নানা কথার উল্লেখ রয়েছে। প্রণবকাকুর সঙ্গে আমার জ্যেঠুর পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল। কাকু জ্যেঠুকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। কাকু বহু জায়গায় উল্লেখ করেছেন – অমল গাঙ্গুলি আমার প্রথম রাজনৈতিক গুরু। আমার জ্যেঠু শুভ্রা কাকিমাকে ‘গীতা’ বলে ডাকতেন। অসম্ভব স্নেহ করতেন কাকিমাকে। নিজের চোখে দেখা সেসব দিনের ছবি আমার মনকে ভারাক্রান্ত করে দেয়।

১৯৮৮তে বহুধাবিভক্ত নকশাল রাজনীতির গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আমায় হতাশ করে দেয়। অথচ কলেজ জীবনে মনপ্রাণ দিয়ে এই রাজনীতিতে আমি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। নকশালবাড়ির আদর্শে আমার আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। স্বপ্ন দেখতাম মানুষের লড়াই একদিন আমাদের দেশের মানুষদের গরিবি ও ভেদাভেদ ঘুচিয়ে দেবে। এরজন্য পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে, এমনকি আমাকে আত্মগোপনেও চলে যেতে হয়। এই মুহূর্তে উচ্চপদে আসীন বহু সাংবাদিকের তা অজানা নয়। তারাও আমাকে নুপুরদি বলেই ডাকতো। সেই স্বপ্ন পূরণ হল না। একরাশ অভিমান নিয়ে প্রবল হতাশায় কলকাতায় থাকবো না ঠিক করলাম। একটা বিজ্ঞাপন দেখে মিলিটারি নার্সিং অফিসার (এএমসি) হিসেবে আর্মি মেডিক্যাল কোর এ যোগ দেওয়ার জন্য সর্বভারতীয় পরীক্ষায় বসলাম। পরীক্ষায় সফল হয়ে পাঁচ বছর ট্রেনিং এর জন্য দিল্লি গেলাম। সে এক কঠিন ট্রেনিং, থাকতাম হস্টেলে।

দিল্লি যাওয়ার কথা কাকু-কাকিমা’কে জানিয়ে দিয়েছিলাম। কারণ সেসময় দিল্লিতে আমার চেনা কেউ ছিলনা। কাকিমা খুব খুশি হয়েছিল। ট্রেনিং এর মাঝে একদিন কাকিমা শুভ্রা মুখার্জি, জ্যেঠু অমল গাঙ্গুলিকে নিয়ে আর্মি হস্টেলে হাজির। বহুদিন পর কাকিমাকে দেখে প্রণাম করার আগেই কাকিমা আমায় জড়িয়ে ধরেছিলেন। বললেন, তুই দিল্লিতে আর আমার বাড়িতে আসবি না? সময় পেলেই আমার বাড়িতে চলে আসবি, বন্ধুদেরও নিয়ে আসবি।

তখন কাকু-কাকিমা তালকোটরার বাড়িতে থাকতেন। কিছুদিন পর কাকিমার পাঠানো গাড়িতেই বন্ধু প্রণতিকে নিয়ে সেখানে হাজির হলাম। রাতে এলাহি খাবারের ব্যবস্থা। কাকু-কাকিমা খেতে এবং খাওয়াতে ভালোবাসতেন। অতিথি পেলে তো কথাই নেই। একসঙ্গেই খেতে বসলাম। সাহিত্য, রাজনীতি, সিনেমা, গান ইত্যাদি নানা বিষয়ে কাকুর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। মন্ত্রমুগ্ধের মত আমরা সেসব কথা শুনতাম। ইন্দিরা গান্ধীর নানান কথা বহুবার শুনেছি, মজার কথাগুলো এখন ঠিক মনে পড়েনা।

উত্তর-পূর্বের কোন রাজ্যে এক সফরের সময় ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধে অনেক বেশি খেয়ে ফেলেছিলেন। সোজা হতেই পারছিলেন না। সেটা দেখে ইন্দিরা গান্ধী খুব মজা পেয়েছিলেন। ছোট ছোট এরকম অনেক ঘটনার কথা কাকুর বলার ধরণে আমরা খুব মজা পেতাম। এসব কথার ফাঁকে কাকিমার সঙ্গেও খুনসুটি করতেন। মাঝে মাঝে ছেলে বাবুয়া (অভিজিৎ) মেয়ে মুন্নিদিও (শর্মিষ্ঠা), আমাদের আসরে যোগ দিত। দিল্লি থাকার সময়ে খাবারের লোভে নানান ভিআইপিদের গল্প শুনতে বহুবার তালকোটরার বাড়িতে গিয়েছি।

কাকু তখন প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যান, ভীষণ ব্যস্ত থাকতেন। বাড়ি গেলে বহুদিন দেখাই হত না। কাকিমা নিজের সাংস্কৃতিক দলের অনুষ্ঠান ও সমাজসেবামূলক কাজে ব্যস্ত। আমি বন্ধুদের নিয়ে অনুষ্ঠান দেখতে যেতাম। সরস গল্প সহজভাবে বলাটাই ছিল কাকুর বিশেষত্ব। কাকিমা কিশোরী মেয়ের মত উচ্ছলতায় হৈচৈ করতেন। নাচ-গান-মজা মিলিয়ে সে ছিল এক আনন্দের দিন।

সাড়ে পাঁচ বছর দিল্লির ট্রেনিং শেষে আমার প্রথম পোস্টিং হল জলন্ধরে, শুনেই কান্নাকাটি, সারারাত ঘুম নেই। অফিসারদের অনুরোধ করেছিলাম, প্রথম পোস্টিং কলকাতায় দেওয়ার জন্য। কিন্তু আর্মির নিয়ম এদিক ওদিক হওয়ার নয়। বাঙালি মেয়ে গান, আড্ডা, সিনেমা, রাজনীতি, লিটল ম্যাগাজিন ছেড়ে যাবে জলন্ধর। পাঁচ বছর আমি এসবের থেকে দূরে, কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলায় ট্রেনিং এ ছিলাম। ভেবেছিলাম কলকাতায় গিয়ে তিনবছর অন্তত হাঁফ ছেড়ে বাচবো।

আনন্দবাজার পত্রিকার ব্যুরো চিফ সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল। আমাকে খুব স্নেহ করতেন, সোজা অফিসে গিয়ে সমস্যাটা বললাম। সুমনদা বললেন – কিছু করতে পারলে একমাত্র প্রণবদাই পারবেন। বুঝতেই পারছিস, ভারতীয় সেনার অর্ডার, আমাদের কিছু করার নেই। চল তোকে তোর কাকুর বাড়িতে নামিয়ে দিই। দেরি করিস না। যথারীতি সেই রাতেই সুমনদা কাকুর বাড়িতে নামিয়ে দিল। খুব ভয় ভয় করে ঘটনাটা কাকুকে বলে ফেললাম। আমার তখন হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে। মুখে চুরুট দিয়ে বই পড়তে পড়তে সবটাই শুনলেন। কাকিমা পাশেই ছিলেন, রাতের খাবার খাইয়ে কাকিমা আর্মির হস্টেলে আমায় নামিয়ে অভয় দিলেন, ‘চিন্তা করিস না, পুরোটাই যখন শুনেছে কিছু একটা হবে, আমিও তো বলবো।’

খুব মনখারাপ। অফিসারদের নির্দেশে বাক্সপ্যাঁটরা গোছাতেও শুরু করেছি। হাতে পাঁচদিন সময়। তারপরেই জলন্ধর চলে যেতে হবে। খাওয়াদাওয়া বন্ধ, মাথা কাজ করছে না। বন্ধুরা নানারকম কথায় মন ভোলাচ্ছে। ঠিক তিনদিনের মাথায় হেড কোয়ার্টার এল ব্লক থেকে আমার ডাক এলো। খুব ভয়ে ভয়ে গেলাম পোস্টিং এর কাগজপত্র আনতে। নার্ভাস লাগছে, জলন্ধর তাহলে যেতেই হবে? কাকু আমার জন্য কিছুই করলো না? ভয়ে সঙ্গে দুজন বন্ধুকেও নিলাম। অফিসে ঢুকতেই এক আর্মি অফিসার আমায় জানালেন,তুমি যা চেয়েছিলে সেটাই হয়েছে। তোমার প্রথম পোস্টিং কলকাতার কম্যান্ড হাসপাতালে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছুটলাম কাকুর বাড়ি। না, কাকুর সঙ্গে সেদিন আমার দেখা হয়নি। কাকিমা ছিলেন, নাড়ু, মুড়কি খাওয়ালেন। গায়ে মাথায় হাত দিয়ে আদর করতে করতে বললেন, জানিস, আমারও মনটা প্রথমে খারাপ লাগছিল। কিন্তু আমি দেখেছি, প্রণব যখন মাথা নিচু করে কোন কথা শোনে, কোন প্রশ্ন করেনা সেই কাজটা হয়ে যায়। কাকিমা একটা শর্তও দিলেন, এবার কলকাতায় গিয়েই বিয়েটা করে নিস। এরপর দিল্লি এলে তোকে যেন একা না দেখি। সেই রাতে বন্ধুদের নিয়ে খুব হুল্লোড় করেছিলাম।

শ্রদ্ধেয় কাকু-কাকিমা তোমরা দুজনেই খুব ভালো থেকো। এতদিন কাকিমা তুমি একা ছিলে। এবার কাকুকেও পাশে পেয়ে গেলে। স্বর্গীয় আনন্দ তোমাদের জীবনকে আবার রঙিন করে তুলুক। আমাদের মত মানুষের মনে তোমরা চিরদিনই বেঁচে থাকবে। তোমরা একটা ইতিহাস।

জানো কাকু, আমার খুব আফসোস হচ্ছিল। যে আর্মি হাসপাতালে তুমি এতদিন ভর্তি ছিলে, আমি ওখানেই ট্রেনিং করেছি। তখন কত ভিভিআইপি আমি দেখতাম। তুমি সেই হাসপাতালেই নিঃশব্দে চলে গেলে। আমি থাকলে নার্সিং এর সুবাদে তোমার সেবা করতাম বা শেষ সময়ে প্রণাম করতে পারতাম।

শ্রদ্ধেয় কাকু-কাকিমা আমার প্রণাম নিও, ভালো থেকো।

ক্যাপ্টেন নিবেদিতা গাঙ্গুলি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here