‘আমি গুরুপত্নী নই, পাতানো মা নই, কথার কথা মা নই, আমি সত্যজননী’ – এমনই বলেছিলেন আমাদের সকলের শ্রীশ্রীমা সারদা।
ভক্তদের কাছে তিনি মা, আবার রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুদের কাছে তিনি সংঘজননী। মায়ের জীবনে, কাজেকর্মে, কথাবার্তায় দেবী ও মানবীর ভাব সুন্দর ভাবে মিশে থাকত, আর সব কিছুকে ছাপিয়ে যেত তাঁর সহজ সরল মাতৃভাব। অগণিত ভক্তের মনে এমন কোনো প্রশ্নই জাগত না যে, মা কে? মা কী? কারণ মা আমাদের, আমরা মায়ের। জ্ঞান, ভক্তি, মুক্তি – এই সবের মূলে মা। সকলেই মায়ের স্নেহ পেত। মাতৃশক্তিই সকল শক্তির আধারভূতা – তাই মা সকলের।
বাগবাজার মায়ের বাড়িতে শ্রীশ্রী সারদা মা আজ লক্ষীরূপে পূজিত হলেন,
করোনা আবহে ২ মাসেরও বেশি বন্ধ থাকার পর অবশেষে খুলছে বাগবাজারে মায়ের বাড়ি। গত জুলাই মাস থেকেই জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে মায়ের বাড়ি।বিজ্ঞপ্তি জারি করতে এই কথা ঘোষণা করা হয় সেই সময়। দর্শনের সময় সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ১০টা ৪৫ মিনিট এবং বিকেল ৪টে থেকে ৬টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত। করোনাবিধি মেনেই মায়ের বাড়িতে ঢোকার অনুমতি পাওয়া যাবে। করোনা পরিস্থিতিতে গত ২৬ এপ্রিল বন্ধ হয়েছিল বাগবাজারের মায়ের বাড়ির দরজা।
একবার মাকে এক ভক্ত প্রশ্ন করেন, “আপনাকে রেখে ঠাকুর আগেই চলে গেলেন কেন?” উত্তরে মা বলেন, “জগতে মাতৃভাব বিকাশের জন্য এ বার আমাকে রেখে গেছেন।” তাই তাঁকে আমরা সংঘজননীই বলি কি জ্যান্ত দুর্গাই বলি, সর্বপ্রথম তিনি হলেন সকলের ‘মা’।
একবার গিরিশচন্দ্র মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “তুমি কী রকম মা?” মা উত্তরে বলেন, “এ শুধু গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, সত্যিকারের মা।”
মায়ের বাড়ি সম্পর্কে জানুন:
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণের পর শ্রীশ্রীমা সারদা স্থায়ী ভাবে কোথাও বসবাস করেননি। কখনও থেকেছেন কামারপুকুরে, কখনও বা জয়রামবাটীতে। কখনও ভক্তসঙ্গে বেরিয়ে পড়েছেন দীর্ঘ তীর্থযাত্রায় আবার কখনও কলকাতায় বলরাম বসুর বাড়িতে কিংবা অন্য কোনো ভক্তের বাড়িতে অথবা বেলুড়ে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে বা অন্যত্র ভাড়াটে হিসাবে কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়। কলকাতায় থাকার কোনো স্থায়ী জায়গা মায়ের ছিল না। এই ব্যাপারটা মায়ের সন্তানদের খুব পীড়া দিত।
স্বামী যোগানন্দের পর শরৎ মহারাজ তথা স্বামী সারদানন্দ মায়ের সেবাভার গ্রহণ করেছিলেন। মা যেখানেই থাকুন স্বামী সারদানন্দ নিয়মিত মায়ের খোঁজখবর নিতেন। প্রয়োজনমতো জিনিস বা ওষুধ পাঠিয়ে দিতেন। ১৩১৪ বঙ্গাব্দের শেষে মা ছিলেন জয়রামবাটীতে। মায়ের শরীর বিশেষ ভালো নেই। শরৎ মহারাজ বার বার কলকাতায় চলে আসতে বলছেন। মা এলেন না।
ইতিমধ্যে সারদানন্দ ভাবলেন এ বার মাকে কলকাতায় নিয়ে এলে তাঁর থাকার একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা করতে হবে। মহারাজ দেখেছেন, মা যেখানেই থাকুন, তাঁর কিছু আত্মীয়স্বজন এবং দু’ চার জন ভক্ত-মহিলা তাঁর সঙ্গে সব সময়েই থাকেন। কোনো গৃহস্থ-ভক্তের পক্ষে এত জনের থাকার সুব্যবস্থা করা খুব কঠিন ও খরচের ব্যাপার। আর এত জনের উপযুক্ত বড়ো বাড়ি ভাড়া করার আর্থিক সঙ্গতিও মায়ের সন্ন্যাসী ভক্তদের নেই। আবার মা কলকাতায় এলে সব সময় সমস্ত সুবিধাযুক্ত বাড়ি যে পাওয়া যেত তা-ও নয়। বাড়ি হয়তো পাওয়া গেল, কিন্তু দেখা গেল তা গঙ্গা থেকে অনেক দূরে। মায়ের রোজ গঙ্গাস্নান করার অভ্যাস। এর ওপর রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মুখপত্র ‘উদ্বোধন’ পরিচালনার জন্য এবং ওই কাজে নিযুক্ত সাধুদের থাকার জন্য একটা বাড়ির প্রয়োজন। একটা গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে নিলেন সারদানন্দ – মায়ের জন্য বাগবাজারে একটা পাকাবাড়ি তৈরি করবেন।
কলকাতায় মায়ের থাকার ব্যবস্থা করার জন্য সারদানন্দ আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত কেদারচন্দ্র দাস তথা ‘খোড়ো কেদার’ (খড়ের ব্যবসা করতেন বলে তিনি ওই নামে পরিচিত ছিলেন) ঠাকুরবাড়ি নির্মাণের জন্য বাগবাজারের গোপাল নিয়োগী লেনে ৩ কাঠা ৪ ছটাক জমি বেলুড় মঠকে দান করেন।
তৈরি হল ‘মায়ের বাড়ি’
জমি তো হল, কিন্তু বাড়ি কী করে হবে? পুঁজি বলতে তো স্বামী বিবেকানন্দের বই বিক্রি বাবদ সঞ্চিত ২৭০০ টাকা। হিসেব করে দেখা গেল, ওই টাকা বাড়ির ভিত তৈরি করতেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। অনেকেরই আপত্তি অগ্রাহ্য করে মায়ের আশীর্বাদ ভরসা করে সারদানন্দ ৫৭০০ টাকা ধার করলেন। এতেও খরচ মিটল না। আরও টাকা জোগাড় করতে হল। শেষ পর্যন্ত প্রায় ১১০০ টাকা খরচ করে ১৯০৮-এর শেষ দিকে সম্পূর্ণ হল সেই বাড়ি।
একতলায় ৬ খানা, দোতলায় ৩ খানা ও তিনতলায় ১ খানা, মোট ১০ খানা ঘর তৈরি হল। এই বাড়িতে ‘উদ্বোধন’-এর অফিস স্থায়ী ভাবে এল ১৯০৮-এর নভেম্বরে এবং নতুন বাড়িতে মা পদার্পণ করলেন ১৯০৯-এর ২৩ মে।
ভক্তদের কাছে এই বাড়িই ‘মায়ের বাড়ি’ নামে পরিচিত হয়ে উঠল। মায়ের সেবক স্বামী সারদানন্দের তত্ত্বাবধানে ‘উদ্বোধন’-এর যাবতীয় কাজকর্ম শুরু হল এই বাড়িতে। তাই সাধারণের কাছে এই বাড়ি ‘উদ্বোধন বাড়ি’ নামেও পরিচিত হল। বাড়ির অদূরেই ভাগীরথী। ছাদে উঠলেই গঙ্গাদর্শন হয়।
দোতলায় ঠাকুরঘর, বেদির উপর ঠাকুর উপবিষ্ট। পাশের ঘরেই থাকতেন মা। স্বামী সারদানন্দ তাঁর আরাধ্য দেবতাকে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে প্রাণভরে সেবাপূজা করতে লাগলেন। এ ছাড়া সদর দরজার পাশে ছোটো ঘরটিতে থেকে মঠ-মিশনের কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। কেউ যদি প্রশ্ন করত, তবে বলতেন, “আমি মায়ের দারোয়ান।” মা-ও বলতেন, “শরৎ আমার ভারী, শরৎ না হলে আমার বোঝা কে নিতে পারে?”
সেই বাড়িতে প্রতি বছর ধুমধাম করে শ্রীশ্রীমায়ের শুভ পদার্পণতিথি পালিত হয়।যথাবিহিত নিয়ম অনুসারে এ বারেও বিশেষ পূজা হচ্ছে মায়ের বাড়িতে। তবে বর্তমান কোভিড ১৯ পরিস্থিতিতে এ বার কোনো বিশেষ উৎসব, প্রণাম-দর্শন, প্রসাদ বিতরণ বন্ধ আছে বলে জানাল উদ্বোধনের কর্তৃপক্ষ।