পার্থ সারথি নন্দী: দীর্ঘ লকডাউনের জেরে বদলে গেছে শহরের চেনা সব ছবি। শুনশান শহরের অলিগলি। পাড়ায় পাড়ায় শোনা যায় না চেনা ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক। মরশুমি ফুলগাছের টব নিয়ে হেঁকে যাচ্ছেন না ফুলচাষিরা, উধাও হয়ে গেছে ‘হরেক মাল ত্রিশ টাকা’র কারবারিদের ভ্যানের ঘণ্টাধ্বনি। নিস্তব্ধ দুপুরে আর শোনা যায় না আইসক্রিমওয়ালার বিচিত্র হ্যাঁকা হাঁকিও। দুপুর গড়াতেই আসতো ফুচকা ওয়ালারা ঘন্টা বাজাতে বাজাতে, তাঁদেরও দেখা নেই আর৷
তবে ভোর হতে–না–হতেই এখন শহর কলকাতার অলিগলিতে শোনা যায় মাস্ক–বিক্রেতাদের ডাকাডাকি। কেউ সাইকেলে, কেউ–বা পায়ে হেঁটে ফিরি করে বেড়ান কাপড়ের তৈরি মাস্ক। পাড়ায় পাড়ায় স্যানিটাইজার ফেরিওয়ালাদের আনাগোনাও শুরু হয়েছে। দুটো কিনলে একটা ফ্রি— এমন প্রলোভনের ডাকও শোনা যাচ্ছে এঁদের মুখে। দৈনন্দিন জীবনের এক অপরিহার্য উপাদান হয়ে গেছে এই মাস্ক ও স্যানিটাইজার। করোনা–সংক্রমণ প্রতিরোধের অন্যতম হাতিয়ার। বাড়ি থেকে বেরোতে হলেই মাস্ক ব্যবহার করা আর ফিরে এসে হাত–পা স্যানিটাইজ করা এখন অবশ্যকর্তব্য। তাই এই দু–তিনটি জিনিসের বিপুল চাহিদা এখন।
সৌভিক সাহা এমনই এক মাস্ক–বিক্রেতা। বনগাঁ লোকাল ট্রেনে এক সময় লেবুর জুস তৈরীর যন্ত্র বিক্রি করে সংসার চালাতেন৷ মুখোশ, দস্তানা তৈরির অভিজ্ঞতাও আছে। এখন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সারা দিন বসে মাস্ক তৈরি করেন, সৌভিকই কাপড়গুলো মাপমতো কেটে দেন, অন্যরা সেলাই করে দেন। নিজের তৈরী প্রতিটা মাস্ক ২০ টাকায়, কেনা মাস্ক ৩০ টাকায় বিক্রি করেন সৌভিক। সকালে পাড়ায় পাড়ায়, বিকেলে বাজার এলাকায় ঘুরে সৌভিকের আয় এখন নেহাত মন্দ নয়।
বড় রাস্তার দু’ধারে ঝাঁ–চকচকে শাড়ির দোকান, মনিহারির দোকান, হরেক বাহারি দোকানের বন্ধ শাটারের সামনে এখন সওদা হচ্ছে শুধু মাস্ক, গ্লাভ্স ও স্যানিটাইজার। সকালে ঝটিতি বাজার সেরে ফেরার পথে সকলেই প্রয়োজনমতো কিনে নিচ্ছেন সেগুলো। অনেকে আবার স্টকে রাখার জন্য একটু বেশি করেই কিনে নিচ্ছেন।
বনগাঁ বাটা মোড়,মতিগঞ্জ,নিউ মার্কেটের সামনে পিপিই কিট বিক্রি করছেন এক মাঝবয়সি ভদ্রলোক। প্রতিটি কিটে রয়েছে গ্লাভ্স, মাস্ক, চশমা, টুপি, জুতো কভার–সহ সম্পূর্ণ পোশাক। দাম নিচ্ছেন ৮০০ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বিক্রেতা জানালেন, বড়বাজার থেকে কিটগুলো তিনি কিনে এনেছেন। বিক্রিও হচ্ছে ভালই। সার্জিক্যাল জিনিসপত্রের সরবরাহকারী পলাশ মজুমদার বলেন, এখন বনগাঁর, অনেক দর্জিই ওই পোশাক তৈরি করছেন। পূর্ব পাড়ার তপন চক্রবর্তী বাড়িতে বানাচ্ছেন মাস্ক এবং বিনা পয়সায় বিলিও করছেন শহরও গ্রামের মানুষের মধ্যে৷তপন বাবুর কথায় বাটা মোড়ের কাছে দোকানটা তো লকডাউনের প্রথম দিন থেকেই বন্ধ, তাই বাড়িতে বসে তৈরী করছি মাস্ক৷ ৮০ জিএসএম কাপড়ে তৈরি না–হলে কোনও হাসপাতাল ওই পোশাক কেনে না। তাই কাপড়ের গুণমানের দিকেও খেয়াল রাখতে হয়। অনেক ডিস্ট্রিবিউটর এখন আলাদা আলাদা জায়গা থেকে পিপিই–র পোশাক, গ্লাভ্স, টুপি, চশমা জোগাড় করে নিজেরা কিট বানিয়েও বিক্রি করছেন।
এখন তো হাসপাতাল, স্বাস্থ্য দপ্তর ছাড়াও দমকল, অডিও–ভিস্যুয়ালের সাংবাদিকেরাও এই পিপিই ব্যবহার করছেন। সমাজতত্ত্ব বিদদের মতে , পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অত্যাবশ্যকীর পণ্যের সংজ্ঞাও বদলে যায়। করোনার আবহে মাস্ক, গ্লাভ্স এখন আমাদের রোজকার ব্যাবহার্যের মধ্যেই ঢুকে গেছে। লকডাউন উঠে গেলেও করোনা–আতঙ্ক ও সংক্রমণ কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে অনেক। তত দিন ফিনাইল, ডেটলের মতো মাস্ক, গ্লাভ্স, স্যানিটাইজার, এমনকী পিপিই–ও আমাদের বাজার সওদায় অপরিহার্য হয়ে থাকবে।
পেট্রাপোল সীমান্তের বাসিন্দা আদুর আলী শেখ ও সৌভিকের মত এক সময় সাইকেলে করে শাড়ী,বিভিন্ন পোষাক বিক্রি করতেন সীমান্তের গ্রাম গুলিতে ঘুরে ঘুরে, এখন তার বদলে বিক্রি করছেন মাস্ক৷ করোনা প্রকৃতির সাথে বদলে দিয়েছে মানুষের জীবন-জিবীকাও৷