দেবন্বিতা চক্রবর্তী,দেশের সময়: পদ্মপুরাণ-এ উল্লিখিত সরস্বতীস্তোত্রম্-এ বর্ণিত হয়েছে, “চন্দ্রের নূতন কলাধারিণী, শুভ্রকান্তি, কুচভরনমিতাঙ্গী, শ্বেত পদ্মাসনে আসীনা, হস্তে ধৃত লেখনী ও পুস্তকের দ্বারা শোভমানা বাগ্‌দেবী সকল বিভবপ্রাপ্তির জন্য আমাদিগকে রক্ষা করুন।”

সতীশ চন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলের সরস্বতী পুজো

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মতে, দেবী সরস্বতী ন্যায় সত্য,ও জ্ঞানের প্রতীক। প্রতি বছর মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে দেবী সরস্বতীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষা,সংগীত ও শিল্পকলায় সাফল্যের আশায় শিক্ষার্থীরা দেবী সরস্বতীর আরাধনা করে থাকেন।


প্রতি বছরের মত এবছরও শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ভারত ও বাংলাদেশ জুড়ে সাড়ম্বরে চলেছে মা সরস্বতীর আরাধনা।সরস্বতী পূজো উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথকভাবে দেশবাসীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, “সরস্বতী পূজা বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ধর্মীয় উৎসব। ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে এই উৎসবে সকলের অংশগ্রহণ এ দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ও ঐতিহ্যে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বাণী অর্চনার এই আবহ অম্লান হোক। জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত হয়ে দেশের প্রতিটি মানুষ সাম্প্রদায়িকতা, অজ্ঞানতা, থেকে মুক্ত হয়ে একটি কল্যাণকর ও উন্নত সমাজ গঠনে এগিয়ে আসবে এটাই সকলের প্রত্যাশা”। বাগ্‌দেবীর চরণে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করেছেন বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের অগনিত মানুষ। গতকাল সকালে যশোর এর এক বাঙাল বাড়িতে জোড়া ইলিশ দিয়ে শুরু হয়েছে পুজো ৷

পঞ্চমী তিথি,তাই অনেকের বাড়িতে গতকালই দেবী সরস্বতীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ রবিবার সকাল ১০টার মধ্যেই পঞ্চমী তিথির সমাপ্তি ঘটেছে। তারই মধ্যে মৃন্ময়ী দেবতার আরাধনা শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাপ্ত করেছেন বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ। ধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে রয়েছে সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা। আবহমানকাল ধরে এখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল ধর্মের মানুষ মিলেমিশে একত্রে বসবাস করে আসছেন। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নে পালন করেছেন। আমি মনে করি, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। পারস্পরিক সম্প্রীতি সামনের দিনগুলোতে আরো সুদৃঢ় হবে – এ আমার বিশ্বাস”।প্রতি বছরের মতো এ বছরও বাংলাদেশের প্রতিটি মণ্ডপে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান, প্রসাদ বিতরণ সমাপ্ত। আজ সারাদিন ধরে চলবে, ধর্মীয় আলোচনা সভা। সন্ধ্যায় চলবে আরতি ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের দেশের অনেক স্কুল, কলেজ ও মন্দিরে সরস্বতীর পূজার আয়োজন করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ হলে চিরাচরিত ঐতিহ্য মেনে বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর পূজা হয়েছে। জগন্নাথ হলের ঐতিহ্যবাহী পূজা ছাড়াও এবারের আকর্ষণ ছিল ক্যাম্পাসের ভিতরের জলাশয়ে চারুকলা অনুষদের বিদ্যার্থীদের তৈরি ৪৫ ফুট উচ্চতার সরস্বতীর প্রতিমা। অথএব এটা বলাই যায়, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের মনে যে অসাম্প্রদায়িক সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন আছে, তারই প্রতিফলন আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি সরস্বতী পূজাকে কেন্দ্র করে।

এপার বাংলাতে সরস্বতী পুজো মানে বাঙালির ভ্যালেন্টাইসডে,এই পুজোকে ঘিরে উন্মাদনা সব মহলে৷ এ বার পুজো পড়েছে রবিবারে। তাই সোমবার বাড়তি এক দিন ছুটি দিয়েছে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, যত সংখ্যক সরস্বতী পুজো এ রাজ্যে হয়, তা দেশের অন্য কোথাও হয় না।

‌বনগাঁয় সরস্বতী পুজোর দিন 
নিরক্ষরদের সাক্ষর করার অঙ্গিকার করে, সরস্বতী পুজোর দিন নিরক্ষর কিছু মানুষকে স্বাক্ষর করার শপথ নিয়ে সরস্বতী পুজো করলেন একদল যুবক। বনগাঁর হাইস্কুল মোড় এলাকার বটতলা যুবগোষ্ঠী এই উদ্যোগ এ এবারে তাঁদের তৃতীয় বর্ষ।যুবগোষ্ঠীর সম্পাদক দেবাঞ্জন সাঁধু,সহস্পাদক উশীনার চন্দ্র,সভাপতি শুভদীপ মুখার্জীর জানান
তিন বছর আগে তারা কয়েকজন বিভিন্ন পেশার যুবক একত্রিত হয়ে সরস্বতী পুজো শুরু করে। তাঁদের পাশাপাশি ওই এলাকাতে আরও একটি পুজোর আয়োজন হচ্ছে। এবছর তাঁরা মিলিতভাবে পুজোর আয়োজন করেছেন।পুজোর পাশাপাশি এদিন পথচলতি ৩০ জন শিশুর হাতে বর্ণ পরিচয় তুলে দেন পুজো উদ্যোক্তারা। এ বছর তাঁরা হস্তশিল্পকে প্রাধান্য দিয়ে পুজোমন্ডপ এবং প্রতিমা তৈরি করছেন। বেত, বাঁশের তৈরি ঝুঁড়ি, কুলো ইত্যাদি উপকরণ দিয়ে পুজো মন্ডপ তৈরি করছে। মন্ডপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিমা তৈরি করা হচ্ছে। পুজোর দিন বাংলার ছৌঁ নাচ, খোল, মহিলা ঢাকিদের উপস্থিতিতে শোভাযাত্রা বের করা হবে। পুজো কমিটিক সম্পাদক দেবাঞ্জন সাঁধু জানান, 'যে দেবীর পুজোয় আমরা জীবনে প্রথম হাতেখড়ি দিই, অঞ্জলী দিই, পড়াশোনার পর্ব শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে অনেকক্ষেত্রেই সেই দেবীকে কিছুটা ভুলে গিয়ে বেশিরভাগ জায়গায় দূর্গাপুজো, কালীপুজো, গনেশ পুজোকে গুরুত্ব দিয়ে বড় বাজেটের পুজোর আয়োজন করা হয়। তাই আমরা সরস্বতী পুজোকে গুরুত্ব দিয়ে তার আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'‌ পুজোর পাশাপাশি এবছর আর একটি অভিনব উদ্যোগ নিয়েছেন পুজো কমিটির সদস্যরা। পুজোর দিন পথ চলতি মানুষদের মধ্যে যারা নিজেদের নামটুকু পর্যন্ত লিখতে পারেন না, তাঁদেরকে দাঁড় করিয়ে বড় বোর্ডে নিজেদের নাম লেখানো শেখানো হবে। যাতে তাঁরা নিজেদের সাক্ষরটুকু করতে পারেন। বনগাঁ হাইস্কুল,কুমুদিনি গার্লস স্কুল, বনগাঁ দীনবন্ধু মহাবিদ্যালয়,বিভূতিভূষণ বিএড কলেজ, চাকদহের সতীশ চন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুল, গোবরডাঙ্গা খাঁটুরা উত্তর পাড়ার এবারের সরস্বতী পুজোর প্রতিমা ও মন্ডপে ভিড় ছিল চোখে পড়ার মত।পাশাপাশি কাকদ্বীপের পুলিশ আধিকারিক অনীল কুমার রায়ের বাড়ীর বনেদিপুজো এবারে চোখে পড়ার মতো৷ এক কথায় এবারের সরস্বতী পুজো দু'বাংলায় ধুমমাতিয়েছে৷

ছবিগুলি তুলেছেন -দেবানন্দ পাইন৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here