সো মোরিরি ও সো কার লেক:
আগের পর্বে লাদাখের প্যাংগং লেক ও ১৫৪০০ ফিট উচ্চতায় রূপসু উপত্যকায় অবস্থিত কাইগার সো লেকের বর্ণনা দিয়েছি। কাইগার সো দেখে এবার আমরা সো মোরিরির(Tso Moriri) দিকে রওনা হলাম। এই হ্রদটি ৪৫২২ মিটার (১৪,৮৩৬ ফুট) উচ্চতায় অবস্থান করছে। এটি সমগ্র ভারতের মধ্যে উচ্চতম স্থানে অবস্থিত ও বৃহত্তম হ্রদ গুলির মধ্যে একটি। সো মোরিরির দৈর্ঘ্যে ১৬ মাইল (২৬ কিমি) এবং প্রস্থে দুই থেকে তিন মাইল প্রশস্ত। সো মোরিরি লেহর দক্ষিণ-পূর্বে ২৪০ কিলোমিটার (১৫০ মাইল) দূরত্বে অবস্থিত।
এখানের চেক-পোস্টে ভালো করে আমাদের আধার-কার্ড চেক করলো। কোরজোক গ্রামটি খুব ছোট একটা জনপদ। সো মোরিরি তে যে পর্যটকরা আসেন তাদের এখানেই থাকতে হয়। এই গ্রামে খুবই সাধারণ মানের হাতে গোনা কটি হোটেল ও লেকের দিকে যেতে কিছু টেন্টের বন্দোবস্ত আছে। শীতকালে এখানে তাপমাত্রা মাইনাস ৪০ ডিগ্রি হয়ে যায়। জুন থেকে দুতিন মাসই পর্যটকদের আনাগোনা থাকে। বিদেশী পর্যটকরাও আসেন। অক্সিজেন তো কম আছেই তার সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া ও ধুলোর ঝড়ের জন্য সো মোরিরি কুখ্যাত।
অনিশ্চিত ওয়েদার এখানের বৈশিষ্ট। আমরা যে হোটেলে উঠলাম সেটা আসলে বাড়ির মধ্যেই কতগুলো ঘর ভাড়া দেওয়া হয়েছে। একটি অল্পবয়সী বৌ কোলে মোটাসোটা একটা বাচ্চা নিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করলো। এক ঘন্টা রেস্ট নিয়ে আবার গাড়িতে করে লেকের ধারে যাওয়া হবে। হোটেলের ইন্টারেষ্টিং রান্না ঘরে বসে গুড়গুড়ি চা খেলাম। নুন ও মাখন দিয়ে তৈরী এই চা খেয়ে পথের সব ক্লন্তি উধাও হয়ে গেল। হাসিখুশি মেয়েটি একহাতে সব কাজ করছিল। বাচ্চার নাম রেখেছে লোটাস আর মায়ের নাম শিরিন। ডিনারে কি খাবো শিরিনকে বলে দিয়ে আমরা লেকের দিকে রওনা হলাম।
লাদাখে প্রতিটি লেকের জলের রং বিভিন্ন রকম। কোনো লেকের সৌন্দর্য অন্য লেকের সঙ্গে ঠিক তুলনা করা যায় না। দেড় কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে আমরা সুলেখা কালির থেকেও ঘন নীল জলরাশির সামনে উপস্থিত হলাম। দূরে কোরজোক গ্রাম দেখা যাচ্ছে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। সূর্যাস্তের গোধূলি আলোতে চারিপাশের পাহাড়ে লাল আভা যা লেকের জলে প্রতিফলিত হচ্ছে।
সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডা বাড়তে লাগলো। হঠাৎ ধুলোর ঝড়ে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। আমরা যে যেদিকে ছিলাম দৌড়ে বাসে উঠে পড়লাম। হাত পায়ের ঝিনঝিন চিনচিন অক্সিজেনের অভাব জানান দিচ্ছে। আমাদের গ্রুপ লিডার ঘোষণা করলো রাতে ডিনারের পর আবার এখানে এসে মিল্কি ওয়ের ছবি তোলা হবে। তখন ঠাণ্ডা আর হওয়ার দাপট আরো বেশি থাকবে। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। হাক্লান্ত অবস্থা। ভাবলাম কেউই বোধ হয় আর যাবে না। কিন্তু দেখা গেলো ডিনাররের পর সবাই ট্রাইপড নিয়ে রেডি। সো মোরিরিতে দেখা মিল্কিওয়ে আমি সারা জীবনেও ভুলতে পারবো না। গোলাপি, বেগুনি ও ফিকে হলুদ রঙের আভা সারা আকাশে ছড়ানো।
মাঝে ঘন দুধের মতন হয়ে আছে তারাদের সমষ্টি বা মিল্কিওয়ে। এক দিকচক্রবাল থেকে ধনুকের মতন এই তারার সমষ্টি অন্য প্রান্তে বিস্তারিত। এক বিচিত্র ঘোরের মধ্যে হোটেলে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন শিরিন বড়ো যত্ন করে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দিল। একদিনে কত যেন আপন হয়ে গেছে। ছেলে কোলে আমাদের বিদায় জানালো। লেহতে ফেরার পথে সো কার(Tso Kar) লেক দেখে নেবো। এই লেকও রূপসা উপত্যকাতে অবস্থিত।
লবণ ও আয়রন সমৃদ্ধ এই লেক টুরিস্টদের চোখের আড়ালেই থেকে গেছে। রাস্তা আর শেষই হচ্ছেনা। চারিদিকে রুক্ষ পাহাড়। হঠাৎই চার পাঁচটি ঘোড়ার সাথে এক ঘোড়সওয়ারের দেখা পাওয়া গেল। এ তো ম্যাকানাস গোল্ডের ম্যাকেনা। এই সুযোগ কি আর হাতছাড়া করা যায়। ক্লিক ক্লিক ফটো উঠতে লাগলো। এসে গেছি লালচে পাহাড়ের ঘেরা সো কার লেকের কাছে। বাস রাস্তা থেকে অনেকটা ঢালু জমি নেমে গেছে লেকের ধারে। জলা ঘাসজমিতে সন্দেহজনক গর্তের ছড়াছড়ি। ষষ্ঠেন্দ্রিও বলছে এই জনমানবহীন জায়গাটা মোটেই সুবিধের নয়। কেউ বললো এগুলো সাপের গর্ত মনে হচ্ছে। ব্যাস সবাই দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠে পড়লাম। কিছু দূর যেতেই বুনো গাধার দলের দেখা মিলল। বাস থেকেই ছবি তুললাম। কাল লেহ থেকে দিল্লি যাওয়ার ফ্লাইট। অসাধারণ উপত্যকাতে আজকেই শেষদিন।
এই রহস্যময় প্রকৃতিকে ছেড়ে ফিরতে হবে। মনটা খুবই খারাপ লাগছে। আবার শহরের ব্যস্ত জীবনে পর্যাপ্ত অক্সিজেনে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠবে। হাতছানি দেবে সো মোরিরির ঘন নীল জলরাশি, ঝোড়ো হওয়া, ধুলোর ঝড় আর রোমাঞ্চকর মিল্কিওয়ে যা প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে অনুভব করেছিলাম।