বাড়ি ফেরার পথে ভরতপুর পড়ে। ভরতপুরের একটু পরেই ফতেপুর সিকরি। ইউপি। যখন পৌঁছলাম রাত এগারোটা। হাইওয়ের উপর একটাই হোটেল খোলা। ফৌজি ধাবা। গাড়ি থেকে নামতেই ছুরির মত হাওয়ায় কাটতে লাগলাম। কেউ কেউ তখনও আগুন পোহাচ্ছে। আমরা কাঁপতে কাঁপতে সুস্বাদু গরম খাবার খেয়েই একটা হোটেলে ঢুকে পড়লাম। সকাল সকাল উঠতে হবে। বার্ড স্যাংচুয়ারি ঘুরে যাবো দুএক ঘন্টায়।
কেওলাদেও ঘানা ন্যাশনাল পার্ক। মাত্র উনতিরিশ বর্গ কিলোমিটারের, কিন্তু বিষ্ময়। টিকিট কেটে দুটো সাইকেল আর একটা রিকশা ভাড়া নিয়ে আমরা তিনজনে অরণ্যের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। আমাদের গাইড ভুপিন্দর সিং। সর্দার। পুনে থেকে অরনিথলজি পড়েছেন। ফরেস্টের মধ্যে গাড়ি নিয়ে ঘোরার নিয়ম নেই। সাইকেল, রিকশা বা পায়ে হেঁটে বারো কিলোমিটার স্ট্রেচ কভার করতে হয়। ভূপিন্দরজি সঙ্গে টেলিস্কোপ আর বাইনোকুলার নিয়ে নিলেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ক্যামেরা! আমি পকেট থেকে বের করে মোবাইল দেখালাম। হো হো করে হেসে উঠে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিলেন ভূপিন্দর সিং।
ঢুকে পড়লাম এক ঝর্ণাধারায়। কত পাখি! একটা গাছ ভর্তি ফুলের মত পাখি ফুটে রয়েছে। পায়রার মত। গাইড বললেন, ইয়েলো ফুটেড গ্রীন পিজিয়ন। তারপরে সাইকেল চালাতে চালাতে, রিকশা চেপে যেতে যেতে, হেঁটে হেঁটে কত পাখি দেখলাম! সারা দুনিয়ার পাখি। কোনওটা সাইবেরিয়া থেকে এসেছে তো কোনওটা চীন থেকে। মঙ্গোলিয়া থেকেও এসেছে ঝাঁকে ঝাঁকে। গাইড ট্রাইপডে টেলিস্কোপ পেতে দেখাচ্ছেন একের পর এক পাখি আর তাদের নাম বলে যাচ্ছেন। আমার কানে সেসব কিছু আসছেনা। আমি শক্তিশালী টেলিস্কোপিক লেন্সে পাখির গলার কাছে রোদ্দুর পড়ে ঠিকরানো ময়ূররং দেখছি, দেখছি ডিজিট্যাল প্রিন্টিং যে ডিজাইনের কল্পনাও করতে পারে না, সেই টেক্সচারড্ ডিজাইন আঁকা রয়েছে পাখিদের মসৃণ পিঠে, পাখায়। একটা পাখির বাঁকানো ঠোঁটের পরে আর একটা ঠোঁট। হর্ণবিল। একটা বাজপাখি আকাশে চলতে চলতে একজায়গায় দাঁড়িয়ে গেলো, হেলিকপ্টারের মত। পাখা আস্তে আস্তে নেড়ে যেন জলে ভেসে আছে। গাইড বললেন, উপরে থেকে শিকার টার্গেট করছে। মানুষের আশিগুণ ওদের দৃষ্টিশক্তি। আমি একবার বাইনোকুলার ধরছি, একবার টেলিস্কোপে চোখ রাখছি। গাইড ভূপিন্দরজি একের পর এক নতুন নতুন পাখি দেখিয়ে যাচ্ছেন। একা পাখি, জোড়া পাখি, ঝাঁকের পাখি। ভেজ খাওয়া পাখি, ননভেজ ইটার পাখি। হাঁস, সারস, ময়ূর, মাছরাঙা, পায়রা, টিয়া, বাজ…। কত পাখি! আমার তিন পাখিভালোবাসা বন্ধু সুজিত টুকাই আর পিতমের নামে অনেকটা ভালবাসা জমা রেখে দিয়ে বেরিয়ে আসলাম ক্ষুদ্রতম ন্যাশনাল পার্ক দেখে। বেশি দেরী করা ঠিক হবে না। নাহলে রাতের মধ্যে বেনারস পৌঁছতে পারবো না।