মিতালী পালধী
বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে সব থেকে বেশি সংখ্যক (১৬,৪৫,০০,০০০) শিশুর বাস ভারতে। পৃথিবীর প্রতি ৫টি শিশুর মধ্যে একটি শিশু ভারতীয়।
অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি ভারতে। শিশুর সঠিক শারীরিক, বৌদ্ধিক তথা মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন হয় সঠিক পুষ্টি। প্রতিটি ব্যক্তির সঠিক বিকাশের সঙ্গে পুষ্টি ও যত্নের বিষয়টি গভীরভাবে জড়িত। সুস্থ শিশু শুধু তাঁর পরিবাবেরই নয়, সমাজ তথা দেশেরও সম্পদ, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ভিত্তি। মহিলা, কিশোরী ও কন্যা শিশু যারা সন্তানের জন্ম দেয় বা ভবিষ্যতে দেবে তাঁদের সঠিক পুষ্টির বিষয়টিকে উপেক্ষা করে শিশুদের পুষ্টি সুনিশ্চিত করার ভাবনা অনেকটাই স্ববিরোধী। শৈশবে অপুষ্টিতে আক্রান্ত হলে তার সুদূর প্রসারী ও জীবনব্যাপী প্রভাব পড়ে শরীর ও মস্তিস্কের ওপর। এই ক্ষতিকর প্রভাব ভবিষ্যতেও কাটিয়ে ওঠা যায় না। শিশুর পুষ্টির মান তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, তার লেখাপড়া, উপার্জনশীলতা এই সমস্ত কিছুকেই প্রভাবিত করে।
তবে শিশুর পুষ্টি, যত্ন এসব নিয়ে আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে যথেষ্ট সচেতনতা এখনও পর্যন্ত গড়ে তোলা যায়নি। এই সচেতনতার অভাব নানা পরিসংখ্যানেও প্রতিফলিত। ভারতে ৫ বছরের কম বয়সী যত শিশু মারা যায় তার শতকরা ৬৯ ভাগই অপুষ্টিজনিত কারণে। ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, যে পৃথিবীতে অপুষ্টি আক্রান্ত প্রতিটি তিনটি শিশুর মধ্যে একটি ভারতীয়। এমনকি সারা পৃথিবীতে যত শিশু মারা যায় তা অর্ধেকই অপুষ্টিজনিত কারণে। অপুষ্টি শিশুর রোগ প্রতিরোধ কমিয়ে দেয়, সঙ্গে সঙ্গে তার শারীরিক বৃদ্ধির হার কমে যায়, সংক্রমণের আশংকাও বাড়ে। এটি একটি দুষ্ট চক্র, যার ফলে শিশু অপুষ্টির শিকার হয়। এই সব শিশুর ডায়েরিয়া, হাম, ম্যালেরিয়া, নিউমোনিয়ার মতো অসুখের আশঙ্কা বাড়ে। দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টিতে শিশু শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার কুপ্রভাব পড়ে পড়াশুনা, শারীরিক সামর্থ্য এমনকি ভবিষ্যৎ উপার্জন ক্ষমতার উপরে। একদিকে কম উপার্জন, অন্যদিকে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বাবদ বিপুল ব্যয় শুধু ব্যক্তি বা পরিবারের আর্থিক ক্ষতিই করেনা সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিকেও দূর্বল করে দেয়।
ভারতীয় শিশুদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত সমস্যা
WHO বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া সংজ্ঞা অনুসারে,
• অপুষ্টি হল শরীরে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি বা আধিক্য।
• প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলির মধ্যে ভারসাম্যের অভাব।
• শরীরে পুষ্টি উপাদানগুলির সঠিকভাবে কাজে লাগার প্রক্রিয়া ব্যহত হওয়া।
অপুষ্টির বিষয়টি তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় – কম পুষ্টি বা পুষ্টির ঘাটতি হওয়া।
শরীরে অনুপুষ্টি উপাদানের ঘাটতি এবং অতিরিক্ত ওজন।
ভারতে অপুষ্টির চিত্র – ২০১৮’র গ্লোবাল নিউট্রশন রিপোর্টে বলা হয়েছে বলা হয়েছে পৃথিবীতে সব থেকে বেশি খর্বাকৃতি (৪,৬৬,০০,০০০) ও খুব রোগা (২,৫৫,০০০০০) শিশু থাকে ভারতে। আমাদের দেশে এই সমস্যাটি বেশ ব্যাপক। সাধারণত তিন রকমের অপুষ্টি দেখা যায়। যেমন, উচ্চতা অনুসারে খুব রোগা,যা চূড়ান্ত পুষ্টির অভাব, খর্বাকৃতি শিশু – যা দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টির ফলশ্রুতি। এই সব শিশুর মস্তিকের পূর্ণ বিকাশ হয়না, তাই বৌদ্ধিক বিকাশও ব্যাহত হয়। আর্থমসামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারে এই ধরণের শিশু বেশি দেখা যায়। সাধারণত ১৮ থেকে ২৩ মাসের শিশুদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়।
আবার কিছু শিশুর ওজন বয়সের তুলনায় কম হয়। এরা খর্বাকৃতি অথবা খুব রোগা দুটোই হতে পারে। অপুষ্টির ক্ষেত্রে বেশিরভাগ বাচ্চারই অ্যানিমিয়া হয় সঙ্গে নানা ভিটামিন যেমন – ভিটামিন এ, বি কমপ্লেক্স , আয়োডিনের সমস্যাও থাকে। তবে অনুপুষ্টির যে সব সমস্যা শিশুদের মধ্যে দেখা যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রক্তাল্পতা।
আবার অতিপুষ্টিও একটি গুরুতর সমস্যা – এক্ষেত্রে শিশু তার উচ্চতার তুলনায় মোটা হয়, ওজন বেশি থাকে। সাধারণত উচ্চ ক্যালরি সম্পন্ন খাবার ও কম কায়িক পরিশ্রম, হর্মোনের সমস্যা এর প্রধান কারণ। এই শিশুদের ভবিষ্যতে ডায়েট সংক্রান্ত অসুখ যেমন – উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস হওয়ার আশংকা থাকে।
NFHS 3 ও 4–এর পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে শিশুদের অপুষ্টির মাত্রা কিছুটা হলেও কমছে। গত ১০ বছরে খর্বাকৃতি শিশুর সংখ্যা মাত্র ১০ শতাংশ কমেছে – যা অবশ্যই ভাবনার বিষয়। ক্রনিক অপুষ্টিতে আক্রান্ত এই সব শিশু ভবিষ্যতে পরিবারের ও দেশের বোঝা হয়ে ওঠার আশংকা থাকে।
যেসব দেশে আর্থিক বিকাশের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে সেসব দেশে শিশুদের থেকে ভারতের শিশুদের খর্বকায় হওয়ার হার কমছে সবচেয়ে মন্থর গতিতে। এরকম অবস্থায় আগামী ২০২২ সালের মধ্যে ৫ বছরের কম বয়সী ৩১.৪ শতাংশ ভারতীয় শিশু খর্বাকৃতি হবে। আশংকা রয়েছে, আগামী দু’বছরে তিনটি শিশুর মধ্যে একটি শিশু খর্বাকৃতি হবে।
অর্থনীতির উপর অপুষ্টির প্রভাব – খর্বাকৃতি শিশু তার আর্থিক পরিণতি সম্পর্কে এক বিশ্বব্যাপী পর্যালোচনায় দেখা গেছে উচ্চতা ১ ইঞ্চি বাড়লে পুরুষদের মজুরি ৪ শতাংশ ও মহিলাদের মজুরি ৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে । জাতির উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য অপুষ্টি কমানোর লক্ষ্যে বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি। বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসেব অনুসারে ছোটবেলায় খর্বাকৃতি হলে প্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় উচ্চতা ১ শতাংশ কম হয়। এই সমস্ত মানুষের আর্থিক উৎপাদন ক্ষমতা কমে ১.৪ শতাংশ।
শৌচাগারের ব্যবহার, পারিপার্শিক পরিচ্ছন্নতা এসবই শিশুর পুষ্টির মানকে প্রভাবিত করে। শিশু গর্ভে আসার সময় থেকে তার জন্মের পর প্রথম দু বছর অর্থাৎ প্রথম হাজার দিন (২৭০ দিন মাতৃগর্ভে ও জন্মের পর প্রথম ২ বছর ৭৩০) এই সময়টা শিশুর শারীরিক ও মানসিক ভিত তৈরির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই সুস্থ শিশুর জন্য প্রয়োজন একজন সুস্থ মা।
ভারতে শিশুদের অপুষ্টির কারণ
• দারিদ্র
• মায়ের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির মান
• নিরক্ষরতা
• কম ওজনের শিশু
• ডায়েরিয়া
• বাড়ির পরিবেশ
• খাদ্যাভ্যাস
• ঠিক মতো হাত না ধোয়া (সঠিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাব)
• নিরাপদ পানীয় জল
শিশুর অপুষ্টির নির্ণায়ক
• জন্মের সময় কম ওজনের শিশু (ওজন ২.৫ কেজির নীচে) শতকরা ২০ ভাগ শিশুর মায়ের গর্ভে বৃদ্ধি কম হয়
• মায়ের দুধ না দেওয়া/কৌটার দুধ খাওয়ানো বোতলে করে।
• ডায়েরিয়া/নিউমোনিয়ার মতো সংক্রমণ
• দেরীতে পরিপূরক আহার শুরু করা। (কম পরিমাণে/যথেষ্ট নিরাপদ নয়/পুষ্টি ঘনত্ব কম)। এতে শিশু প্রয়োজনীয় ক্যালরি প্রোটিন ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস পায়না ফলে ওজন কমে সংক্রমণ হয় বার বার।
পুষ্টি সংক্রান্ত কর্মপন্থা – অপুষ্টির সমস্যা মোকাবিলায় সরকারি স্তরে ICDS, NRHM, মিড-ডে-মিল স্কিম, জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা মিশন – এরকম নানা কর্মসূচী হাতে নেওয়া হয়েছে। নীতি আয়োগ ২০১৭-র সেপ্টেম্বরে জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচী প্রকাশ করে। অপুষ্টির সমস্যা বিশ্লেষণের পাশাপাশি অবস্থার পরিবর্তনে কি কৌশল নিতে হবে তার দিশা রয়েছে এই কর্মপন্থায়। দেশে পুষ্টির ঘাটতি কমাতে চারটি নির্ণায়ক প্রক্রিয়া একযোগে কাজ করবে। এগুলি হল – স্বাস্থ্য পরিষেবা, খাদ্য, পানীয় জল ও পরিচ্ছন্নতা এবং আয় ও জীবিকা। পুষ্টি সংক্রান্ত পরিষেবা চাহিদা বাড়াতে মানুষের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন আনা এবং ‘স্বচ্ছ ভারত স্বাস্থ্য ভারত’এর সঙ্গে কুপোষণ মুক্ত ভারতের লক্ষ্যে জন আন্দোলন গড়ে তোলার উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় পুষ্টি সংক্রান্ত কর্মপন্থার অনুসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৮-র মার্চে রাজস্থানের ঝুনঝুনুতে “পোষণ অভিযান”-এর সূচনা করেন। এতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়গুলি ২০২২ সালের মধ্যে দেশ থেকে অপুষ্টি দূরীকরণের লক্ষ্যে একযোগে কাজ করছে। এই অভিযানের মূল লক্ষ্য হল জেলা গুলিতে অপুষ্টির হার কমানো, সেখানে খর্বাকৃতি শিশুর সংখ্যা কমানো, অঙ্গনওয়ারি কেন্দ্রগুলির পরিষেবার উন্নতি করে তার পুষ্টির মান বাড়ানো, এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে গর্ভবতী, প্রসূতী মা, পর্যাপ্ত পুষ্টির ব্যবস্থা করা সামগ্রিক উন্নতির জন্য। মহিলা ও শিশুবিকাশ মন্ত্রণালয় পোষণ অভিযানে প্রথম বছরে ৩১৫টি জেলায়, দ্বিতীয় বছরে ২৩৫টি জেলায়, তৃতীয় বছরে বাকি জেলাগুলিতে এই কর্মসূচী রূপায়িত করবে।
জাতীয় পুষ্টি মাস – পোষণ অভিযানের অঙ্গ হিসেবে ১লা থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর সারা দেশে পালন করা হচ্ছে জাতীয় পুষ্টি মাস। যার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে পুষ্টি সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। এবারের পুষ্টি মাসে যে কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে তাতে মানুষ যাতে নিজেই নিজের পুষ্টি বিশেষত মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টসের যোগান পায় সে ব্যাপারে তাদের উদ্যোগী করে তোলা। প্রতিটি মানুষকে সব্জি বাগান বা টবে শাকসব্জি, ফলের গাছ লাগানোর কথা বলা হয়েছে। বিশেষত কোভিড অতিমারীর সমস্যায় ইমিউনিটি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এই গাছ লাগানোর ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমাদের শ্লোগান হোক ইচ ওয়ান, প্ল্যান্ট ওয়ান। অপুষ্টির প্রতিরোধে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হলো ৫ বছরের কম বয়সী শিশু যারা গুরুতর ও চরম অপুষ্টিতে ভুগছে তাদের সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া।
ভারতে অপুষ্টিজনিত সমস্যা গভীর, ব্যাপক ও বহুমাত্রিক। এই সমস্যার মোকাবিলায় প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি। বছরে একটি পুষ্টি মাস উদযাপন তাই যথেষ্ট নয়। সচেতন ভাবনা ও কর্ম পরিকল্পনা রূপায়ণের মাধ্যমে বছরে প্রতিটি দিনে নিজেদের অপুষ্টির বিরুদ্ধে নিয়োজিত করতে হবে নতুবা অপুষ্টি মুক্ত ভারত অধরাই থেকে যাবে।
লেখিকা বিশিষ্ট খাদ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)