কল্যাণ চক্রবর্তী এবং অরিত্র ঘোষ দস্তিদার

চর্যাপদের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে আছে। তিনি মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৯০৭ সাল। সংস্কৃত পুঁথির চর্চা করছেন। সংস্কৃতের পাশাপাশি বাংলাভাষার পুঁথিও তাঁর মনযোগ সমানভাবে কেড়ে নিল। তারই অনুষঙ্গে ধূসর পুঁথি-পাণ্ডুলিপির সন্ধানে তিনি নেপালে গেলেন। অনুসন্ধানরত হরপ্রসাদের নেপাল ভ্রমণ চলতেই থাকলো। হয়তো ভারতবর্ষে ইসলামিক শাসনে বহু পুঁথি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, যদি নেপালে হিন্দু শাসনের আবহে কিছু বেঁচে থাকে, যদি পাওয়া যায় মূল্যবান মণিমাণিক্য! হ্যাঁ, তিনি পেলেন। রাজদরবার থেকেই তাঁর পরম সংগ্রহ হল বাংলা ভাষার প্রথম আবিষ্কৃত গ্রন্থ চর্যাচর্য্য বিনিশ্চয়। ১৯১৬ সালে সেই পুঁথির নিবিড় পাঠ করে তিনি লিখলেন হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় রচিত বৌদ্ধ গান ও দোঁহা। বাংলার সাহিত্যের ইতিহাসে এক উত্তাল ও উল্লেখযোগ্য গবেষণার সূত্রপাত ঘটল।

তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। এশিয়াটিক সোসাইটি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি ছিলেন। সি.আই. আর উপাধি-প্রাপ্ত এক বাঙালি বিদ্যাবিদ তিনি। লন্ডনের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটিও তাঁর গবেষণায় মুগ্ধ। আর হ্যাঁ, পাশাপাশি শ্রীরাম-কর্তব্যও তিনি পরম আগ্রহে সম্পন্ন করেছেন। তিনিই সন্ধ্যাকর নন্দী প্রণীত রামচরিতম অর্থাৎ রামচরিতমানস পুঁথির সংগ্রাহক। অথচ তাঁকে কেউ সাম্প্রদায়িক বললেন না। আজকে ‘জয় শ্রীরাম’ উচ্চারণ করলে তাই কেউ সাম্প্রদায়িক হয়ে যাবেন না। বাংলায় শ্রীরামচন্দ্রের শিকড় অনন্ত গভীরে। শুনবেন? তাঁর বিখ্যাত বইগুলির অন্যতম হচ্ছে ‘বাল্মিকীর জয়’, ‘সচিত্র রামায়ণ’। পক্ষ অবলম্বন যদি করতেই হয়, তবে তাঁর মতোই গর্বিত বাঙালি হতে হবে, বাংলাভাষাকে ভালোবাসতে হবে। আজকের বাঙালি তাঁকে যেন ভুলে না যান।

আজ ভারততত্ত্ববিদ মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর জন্মবার্ষিকী (৬ ই ডিসেম্বর, ১৮৫৩)। এই হরপ্রসাদের লেখনী আবিষ্কার করেছিলেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিম সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় লেখালেখি করেন হরপ্রসাদ। তাঁকে ভারততত্ত্বে জারিত করে দিলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র। বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে হরপ্রসাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্কের ভিত্তিতে একটি ছোট্ট তথ্য পরিবেশিত হল।

কাঁঠালপাড়ায় বঙ্কিমচন্দ্রের বাগান
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশায় নৈহাটিতে বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়ির কাছাকাছি থাকতেন। তাঁর স্মৃতিচারণায় বঙ্কিমচন্দ্রের উদ্যানপ্রীতির পরিচয় পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বঙ্কিম সান্নিধ্যে তিনি একজন যথার্থ লেখক হয়ে উঠেছিলেন। তিনি লিখছেন,
“একটি ছোট্ট ফুলের বাগান, দুকাঠাও পূরা হইবে না। ঘর দুটি একত্রে যতখানি লম্বা, বাগানটিও ততখানি লম্বা, আড়েও ঐরূপ, তিনদিকে পাঁচিল দিয়া ঘেরা, সে পাঁচিলের আগায় একটি আলসে ও তাহার নীচে একটি বেঞ্চি। চারদিকেই এইরূপ। বাগানের ঠিক মাঝখানে একটি চৌকা গাথা, হাতখানেক উচা, তাহার মাঝখানে আবার একটি চৌকা হাতখানেক উচা। চারিদিকেই যেন গ্যালারি মত। এই সমস্ত গ্যালারিতে চারিদিকেই টব সাজানো থাকিত। টবে নানারূপ রঙিন ফুল ও পাতার গাছ। বাগানে আর যেটুকু জমি ছিল, তাহাতে শুরকির কাঁকর দিয়া রাস্তা করা। বাকী জমিতে যূ্ঁই, জাতি, কুঁদ, মল্লিকা ও নবমালিকার গাছ। বর্ষাকালে ফুল ফুটিলে সব সাদা হইয়া যাইত, এবং বৈঠকখানাটি গন্ধে ভরপুর হইয়া যাইত। বঙ্কিমবাবু বাগানটিকে বড়ই ভালবাসিতেন, যতদিন তিনি বাড়ি থাকিতেন, বাগানটি খুব সাবধানে পরিষ্কার রাখিতেন, এবং মাঝে মাঝে অবসর পাইলে আলসেটিতে হেলান দিয়া বেঞ্চির উপর বসিয়া ফুলের বাহার দেখিতেন।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here