দেশের সময়: গুরু পূর্ণিমার আগের দিন। শ্রীগৌরাঙ্গ বললেন, শ্রীপাদ, কাল, আপনি কোথায় ব্যাস পুজো করবেন?
নিত্যানন্দ শ্রীবাসকে দেখিয়ে বললেন, এই বামনার ঘরে।
নিতাইয়ের ইচ্ছা শুনে শ্রীবাসকে বললেন গৌরাঙ্গ, তোমার তো বোঝা বাড়বে! শ্রীবাস বললেন, কী বলছেন প্রভু। সবই তো আপনার কৃপা। ঘরে ঘি-দুধ সবই রয়েছে। শুধু পুজোর পদ্ধতি-পুস্তক নেই। সে আনিয়ে নেব আমি।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। যে যাঁর বাড়ি চলে গেলেন। শ্রীবাসের ঘরে রয়েছেন নিতাই। মাঝরাতে আচমকা হুঙ্কার শুনে ধরফরিয়ে উঠলেন শ্রীবাস। কী হয়েছে? দেখলেন, ঘরের মাটির মেঝেতে আছাড় মেরে নিতাই তাঁর অবধূত জীবনের চিহ্ন বিশেষ কমণ্ডলু ভেঙে ফেলেছেন। এ কী! কমণ্ডলু ভাঙলেন কেন?
কী করলেন আপনি? আর্তনাদ করতে থাকেন শ্রীবাস।
শান্ত হয়ে উত্তর দেন নিতাই। বলেন, যাঁকে পাওয়ার জন্য এই কমণ্ডলুকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছি তীর্থে তীর্থে, তাঁকে যখন পাওয়া হয়েই গিয়েছে, তখন এটিকে আর বয়ে বেড়ানোর দরকার কী?
ভক্তিরত্নাকর গ্রন্থে বলা হয়েছে,
বুঝি তাঁর সর্ব্ব মনোরথ পূর্ণ হৈল।
তেঞি নদীয়াতে দণ্ড পরিত্যাগ কৈল।।
পরবর্তী সময়ে নিত্যানন্দই চৈতন্য মহাপ্রভুর সন্ন্যাস জীবনের চিহ্নস্বরূপ দণ্ডটি ভেঙে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।
না, না। মতিগতি ভালো নয়। নিমাইকে খবর দিতে ছুটলেন শ্রীবাস।
তখন ভোরের আলো ফুটেছে। নিমাই এলেন শ্রীবাসের বাড়িতে। দেখলেন, ঘরের দাওয়াই পড়ে রয়েছে ভাঙা কমণ্ডলু। নিতাইয়ের বাহ্যজ্ঞান নেই। তিনি অট্টহাস্য করছেন। নিমাই কোনও কথা জিজ্ঞেস করলেন না। শান্তভাবে বললেন, চলো। গঙ্গাস্নান সেরে আসি।
দল বেঁধে গঙ্গাস্নানে গেলেন নিমাই। সঙ্গে গেলেন নিতাইও। গঙ্গায় তিনি ভাসিয়ে দিলেন ভাঙা কমণ্ডলু।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁর গৌরাঙ্গ পরিজন গ্রন্থে বর্ণনা করছেন, গঙ্গায় স্নান করতে নেমে কুমির দেখতে পেলেন নিতাই। দেখামাত্র কুমির ধরতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সাঁতার কেটে এগিয়ে যেতে লাগলেন কুমিরের দিকে। সবাই হায় হায় করে উঠলেন। কিন্তু কার কথা কে শোনে। এবার নিমাই শাসনের সুরে বলে উঠলেন, নিতাই উঠে এসো। ব্যাসপুজোর দেরি হয়ে যাচ্ছে।
এতটুকুতেই কাজ হল। কুমির ধরতে চাওয়ার বাসনা ছেড়ে উঠে এলেন নিতাই।
পুজোর আয়োজন হল। শ্রীগৌরাঙ্গের নির্দেশে বন্ধ করা হয়েছে ঘরের দরজা। ভক্তরা ভিতরে হরিধ্বনি করছেন। পুজোর শেষে শ্রীবাস নিত্যানন্দের হাতে মালা দিয়ে বললেন, এটি ব্যাসদেবের আসনে দিন। এটাই পুজোর নিয়ম। কিন্তু মালা হাতে এদিকে ওদিক কী যেন খুঁজতে লাগলেন নিত্যানন্দ। বললেন, কার গলায় পরাব এই মালা?
শ্রীবাস বলেই চলেছেন, নতুন প্রভু ব্যাসদেবের আসনে মালা দিন। মন্ত্র পড়ুন। একি কী করছেন আপনি? মালা দিন আসনে।
যত শুনে নিত্যনন্দ করে হয় হয়।
কিসের বচন পাঠ প্রবোধ না লয়।।
(চৈতন্যভাগবত)
পুজোর ঘর থেকে শ্রীগৌরাঙ্গকে ডাকছেন শ্রীবাস পণ্ডিত। প্রভু, আসুন। দেখে যান। নতুন প্রভু পুজোর কোনও নিয়ম মানছেন না। এ যে অকল্যাণ হবে। নিত্যানন্দ নীরব। নিস্পন্দ।
নিমাই এসে ধমকের সুরে বললেন, নিতাই ব্যাসকে মালা পরাও। অমনি আনন্দে বিগলিত হয়ে উঠলেন নিত্যানন্দ। এক ঝটকায় শ্রীগৌরাঙ্গের গলায় পরিয়ে দিলেন সেই মালা। বুঝিয়ে দিলেন তিনিই যুগের উপাস্য বা আরাধ্য। তাঁর অনুশাসনই এ যুগে পালনীয়। এর পরই গৌরসুন্দর ধারণ করলেন ষড়ভূজ মূর্তি।
চৈতন্যভাগবতে বলা হয়েছে
ছয় ভুজ বিশ্বম্ভর হইল তৎকাল।
শঙ্খ চক্র গদা পদ্মশ্রী হৈল মুষল।
দেখিয়া মূর্চ্ছিত হৈল নিতাই বিহ্বল।।
মহাপ্রভুর একই অঙ্গে দ্বারকানাথ শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীবলরামের সম্মিলন দেখে নিত্যানন্দ বিস্ময়ের আতিশয্যে মূর্চ্ছা গেলেন।
শাস্ত্র বলছে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নিত্যানন্দ প্রভুকে প্রথমে তাঁর ষড়ভুজ রূপ দর্শন করান। তার পর ত্রিভঙ্গ চতুর্ভুজ সুন্দর রূপ এবং সবশেষে দ্বিভুজ ব্রজেন্দ্রনন্দন রূপ দেখান।
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলছেন,
প্রথমে ষড়ভুজ তারে দেখাইল ঈশ্বর।
শঙ্খচক্রগদাপদ্ম-শার্ঙ্গ বেণুধর।।
তবে চতুর্ভুজ হৈলা, তিন অঙ্গ বক্র।
দুই হস্তে বেণু বাজায়, দুয়ে শঙ্খ-চক্র।।
তবে দ্বিভুজ কেবল বংশীবদন।
শ্যাম-অঙ্গ পীত বস্ত্র ব্রজেন্দ্রনন্দন।।
বলরামভাবে আবিষ্ট হয়ে নিত্যানন্দের কাছে হল ও মুষল প্রার্থনা করলেন গৌরসুন্দর। নিত্যানন্দ শ্রীগৌরাঙ্গের দিকে বাড়িয়ে দিলেন হাত। ভক্তরা দেখলেন, গৌরাঙ্গকে হল ও মুষল দিলেন নিত্যানন্দ। গৌরাঙ্গ তা গ্রহণ করলেন। ভক্তরা এনে দিলেন গঙ্গাজল। তা পান করলেন গৌরসুন্দর। এর পর ভক্তরা দেখলেন, শ্রীগৌরাঙ্গ হল-মুষল-ধর-বলরাম মূর্তিতে বিরাজ করছেন। আর স্তুতি পাঠ করতে করতে নৃত্য করছেন নিত্যানন্দ।
বিশ্বম্ভর চৈতন্যের
নিত্যানন্দ
সহজিয়া বৈষ্ণব আন্দোলনের বিদ্রোহী পুরুষ
লেখক: ব্রতীন দাস ৷