দেশের সময়: দিনটা আষাঢ় মাসের শুক্লা চতুর্দশী। অর্থাৎ ঠিক আজকের দিনেই নিত্যানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল নিমাইচাঁদের। ঠিক কীভাবে ঘটেছিল এই মহামিলন?
নিতাইয়ের ভাবান্তর হল। নবদ্বীপে ছুটে এলেন তিনি। পথে আসতে আসতে বিভোর হন বলরামভাবে। স্নেহের ভাই কৃষ্ণের সঙ্গে সেই কবে ছাড়াছাড়ি হয়েছে, কতদিন পর আবার দেখবেন তাঁকে, ভাবতেই আনন্দে ভরে ওঠে নিতাইয়ের মন। খুশিতে নৃত্য করে ওঠেন। কখনও রাস্তায় লাফ দেন। গড়াগড়ি দেন পথের ধুলোয়। সবাই দেখে, আর মনে মনে ভাবে, এ সন্ন্যাসী নিশ্চয় পাগল।
কিন্তু কে, কী বলল তাতে কান দেন না নিতাই। লক্ষ্যে অবিচল তিনি। যাঁর জন্য নবদ্বীপে ছুটে আসা, কতক্ষণে তাঁর দেখা পাবেন, তা ভেবেই ছটফট করতে থাকে নিত্যানন্দের মন। পথে যাঁকে পান, তাঁকেই জিজ্ঞেস করেন, তোমরা আমার কানাইকে দেখেছ। কোথায় গেলে তাঁকে পাব। সেই কবে ছাড়াছাড়ি হয়েছে। কতদিন দেখিনি তাঁকে। বলতে বলতে চোখ দুটো জলে ভরে আসে নিতাইয়ের।
নবদ্বীপে এসে নিমাই পণ্ডিতের বাড়ি খুঁজতে থাকেন নিতাই। কিন্তু শেষমেশ যে কারণেই হোক, তিনি নন্দন আচার্যর বাড়িতে এসে ওঠেন।
জানিঞা আইলা ঝাট নবদ্বীপপুরে।
আসিয়া রহিলা নন্দন আচার্যর ঘরে।।
(চৈতন্যভাগবত)
এদিকে, নিমাই তখন নিতাইয়ে আচ্ছন্ন। তিনি ভক্তদের ডেকে বললেন, জানো, কাল রাতে আমি এক অপূর্ব স্বপ্ন দেখেছি, একটি তালধ্বজ রথ আমার কুটিরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। সেই রথ থেকে নামছেন রজত পর্বতের মতো এক বিশালবাহু মহাপুরুষ। তাঁর পরনে নীল কাপড়। মাথায় পাগড়ি। হাতে বেত বাঁধা কানা কলসি। কুণ্ডল। সাক্ষাৎ হলধর। আমায় বললে, এ বাড়ি কি নিমাই পণ্ডিতের?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার পরিচয়? তিনি বললেন, আজ নয়, কাল জানতে পারবে। আমার মনে হচ্ছে, নবদ্বীপে নিশ্চয়ই কোনো মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়েছে। শ্রীবাস, হরিদাস তোমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ করো। দেখো, কে তিনি? কার বাড়িতে এসেছেন?
জয়ানন্দ অবশ্য বলেছেন, মুকুন্দ ভারতীই গৌরাঙ্গকে নিতাইয়ের নবদ্বীপে আসার বার্তা দিয়েছিলেন।
হেন কালে মুকুন্দ ভারতী তথা গিয়া
গৌরাঙ্গে এসব কথা কহিল বসিয়া।।
নিমাইয়ের কথা শুনে ছুটলেন ভক্তরা। খোঁজ চলল এ বাড়ি, ও বাড়ি। কিন্তু কোথায় তিনি। কোত্থাও তো নেই। হতাশ হয়ে ফিরে এলেন শ্রীবাসরা। বললেন, তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। কিন্তু কাউকে তো পেলাম না। শ্রীবাসের কথা শুনে মুচকি হাসলেন নিমাই। বললেন, চলো। আমি নিজে যাব। সটান হাজির হলেন নন্দন আচার্যর বাড়িতে।
জয়ানন্দের বর্ণনায়, মুকুন্দ ভারতীর কাছ থেকে খবর পেয়ে সদলবলে নন্দন আচার্যর বাড়িতে গেলেন নিমাই। সাক্ষাৎ হল নিতাইয়ের সঙ্গে।
বহুদিনে দুই ভাই নবদ্বীপে দেখা।
উথলিল প্রেমসিন্ধু নাঞি লেখাজোখা।।
শ্বাস হাস স্বেদ কম্প হুংকার গর্জন।
সঘন চুম্বন পুন পুন আলিঙ্গন।।
পুলকে উজোর দেহ অপূর্ব্ব বদন।
অবশেষে গৌরাঙ্গ ষড়ভুজ দরশন।।
বিশ্বম্ভর চৈতন্যের
নিত্যানন্দ
সহজিয়া বৈষ্ণব আন্দোলনের বিদ্রোহী পুরুষ
লেখক: ব্রতীন দাস
অন্যত্র অবশ্য বলা হচ্ছে, নিমাই নন্দন আচার্যর বাড়ি পৌঁছে দেখলেন, অবধূতের বেশে বসে আছেন এক অপূর্ব সুন্দর পুরুষ। পদ্মচক্ষু। সূর্যের মতো তেজ তাঁর শরীরে। ধ্যান সুখে মগ্ন। হাসিমুখ। পরনে নীল বস্ত্র। স্বপ্নে যেমন দেখেছিলেন, ঠিক তেমন।
ধ্যানসুখে পরিপূর্ণ হাসয়ে সদায়।
দিনটা আষাঢ় মাসের শুক্লা চতুর্দশী। প্রণাম করে নিতাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন নিমাই। তখন কেমন লাগছিল বিশ্বম্ভরকে। চৈতন্যভাগবতে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তার।
বিশ্বম্ভর মূর্তি যেন মদন সমান।
দিব্য গন্ধ-মাল্য বাস পরিধান।।
কি হয় কনক দ্যুতি সে দেহের আগে।
সে বদন দেখিতে চাঁদের সাধ লাগে।।
দেখিতে আয়ত দুই অরুণ নয়ন।
আর কি কমল আছে হেন হয় জ্ঞান।
সে আজানু দুই ভুজ হৃদয় সুপীন।
তাহে শোভে যজ্ঞসূত্র অতি সূক্ষ্ম ক্ষীণ।।
নন্দন আচার্যের বাড়িতে থাকার সময় নিত্যানন্দকে কেমন লাগছিল, তার ছবি এঁকেছেন বৃন্দাবন দাস।
মহা অবধূত বেশ প্রকাণ্ড শরীর।
নিরবধি গতিস্থান দেখি মহা ধীর।।
অহর্নিশ বদনে বোলয়ে কৃষ্ণনাম।
ত্রিভূবনে অদ্বিতীয় চৈতন্যের ধাম।।
নিজানন্দে ক্ষণে ক্ষণে করয়ে হুঙ্কার।
মহা মত্ত যেন বলরাম অবতার।।
লোচনদাস বলছেন, নিমাই যখন নিত্যানন্দের দেখা করতে যান, তখন নিতাইয়ের গায়ে শোভা পাচ্ছে অলঙ্কার।
এই মনে আনন্দে সানন্দে চলি যায়।
দেখিল ত অবধূত নিত্যানন্দ রায়।।
আরক্ত গৌরাঙ্গ কান্তি পরম সুন্দর।
ঝলমল অলঙ্কারে অঙ্গ মনোহর।।
কটিতটে পীতবাস বিরাজিত শোভা।
শিরে লটপটি পাগ চম্পকের আভা।।
চৈতন্যমঙ্গলের মধ্যখণ্ডেও বলা হয়েছে,
অঙ্গদ কঙ্কণ হার কেয়ূর কিঙ্কিনী।
গণ্ডযুগে কুণ্ডল যেমন দিনমণি।।
বৃন্দাবন দাসের মতে, নীলাচল থেকে ফিরে এসে পানিহাটিতে রাঘব পণ্ডিতের বাড়িতে থাকার সময় নিতাই অলঙ্কার পরতে শুরু করেন।
যদিও ঈশাননাগর তাঁর অদ্বৈতপ্রকাশ গ্রন্থে বলছেন,
ললাটে তিলক শোভে যৈছে চন্দ্র প্রভা।
তুলসী কাষ্ঠের মালায় কণ্ঠ করে শোভা।।
সুতরাং নিতাইয়ের বেশভূষা নিয়ে যথেষ্টই মতপার্থক্য আছে। বৃন্দাবন দাস তাঁর গ্রন্থে বলছেন, অবধূতের চিহ্ন হিসেবে নিতাইয়ের হাতে দণ্ড ও কমণ্ডলু ছিল। বৃন্দাবন দাসের পাশাপাশি মুরারি গুপ্ত ও লোচনদাস বলেছেন, নিতাই সেসময় কৌপিন পরেছিলেন।