লিখছেন-
দেবাশিস রায়চৌধুরী
বাসে গান বাজছে,”মুসাফির হুঁ ইয়ারো, না ঘর হ্যায় না ঠিকানা,মুঝে চলতে জানা হ্যায়, বস চলতে জানা”।কিশোরকুমার।না রিমেক নয় অরিজিনাল।গান শুনতে শুনতে মন হু হু করে উঠছে।আমাদের ভ্রমণপর্ব প্রায় শেষ পর্যায়ে।আর মাত্র কয়েকটা দিন তারপর আবার দিনগত পাপক্ষয়।এসব ভাবলেই মন কেমন উদাস হয়ে যায়।মুঠি আলগা হয়ে আসছে, দ্রুত ঝরে যাচ্ছে হাসিখুশির দিনগুলো।হেমন্তবাবু মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে ওঠেন,”দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না,
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।কান্নাহাসির বাঁধন তারা সইল না,সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি”।জানলার ধারে বসে বাইরে তাকিয়ে দেখছি অরণ্যের সবুজ আকাশের নীল আর পর্বত শৃঙ্গের শুভ্রতা।

যে কথা বলা হয়নি সেটা হল, এখন বাস চলেছে সেটা নোনৈতাল অভিমুখে।ঘণ্টাখানেক আগে আমরা কৌসানি থেকে বেরিয়ে পড়েছি।বেড়াতে এসেও একটা নিয়মে বাঁধা পড়তে হয়।প্রতিদিন সকালে সাড়ে ছটা থেকে সাতটার মধ্যে ঘরে ঘরে চা পেয়ে যাই।তারপর কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে স্নান সেরে প্রাতরাশ শেষ করে বেরিয়ে পড়তে হয়।কোনও দিন মালপত্র বেঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়া আবার কোনও দিন মুক্তহাতে বেরিয়ে পড়া।আজ আমরা সমাল বেরিয়েছি।সকালে আকাশ মুখ ভার করে ছিল। মনখারাপ-মেঘের হালকা চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিল সে।ফলে তার উজ্জ্বল মুখ আমরা দেখতে পাইনি।হোটেল ছাড়ার সময় সেই মনখারাপিয়া মেঘ আমাদের সঙ্গ ছাড়ল না।একে মন ভালো নেই তার উপরে কিশোর কুমার গেয়ে চলেছেন,”দিন নে হাথ থাম কর ইধার বিঠা লিয়া,রাত নে ইশারে সে উধার বুলা লিয়া,সুবহ সে শাম সে মেরা দোস্তানা”।আহা,আহা!অ্যাদ্দিন তো আমরাও ওইরকম ছিলুম গো।দিন আমাদের হাত ধরে আলমোড়া রোদ্দুরে বসিয়েছে তো রাত আমাদের ডেকে নিয়েছে মুন্সিয়ারির চাঁদনী আকাশের নীচে।চকৌরির ভোর আর কৌসানির সন্ধ্যার সাথে আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছে।
আজ সকালে ঘুম ভাঙল কৌসানিতে রাতের বিছানা পাতা আছে নৈনিতালের হোটেলে।আমি অন্যমনস্ক হয়ে এসব ভাবছিলাম বলে বাসের ভিতর সবাই নিশ্চুপ ছিল তা কিন্তু নয়।ভিতরে বেশ তর্কাতর্কি চলছে।সিরিয়াস কিছু হচ্ছে নাকি?কৌতূহলী হয়ে কান পাতি।নাহ্ তেমন কিছু নয়। তর্ক চলছে অমিতাভ আর শাহরুখ ফ্যানদের মধ্যে।স্বাভাবিকভাবেই নবীনরা সকলে শাহরুখ তো প্রবীনদের প্রায় সকলেই অমিতাভের ফ্যান।পাহাড় চড়ায় ছোটদের দম বেশি থাকতে পারে কিন্তু যুক্তিতর্কে ওদের দমের ঘাটতি বোঝা যাচ্ছিল।শেষমেশ অবশ্য তর্ক অমীমাংসিত থাকে।উত্তেজনা কেমন থিতিয়ে আসে।তর্ক বেশ জমে উঠেছিল, এইভাবে ঝিমিয়ে যাওয়া আমার পছন্দ হয় না।তাই আগুনে সামান্য ঘৃত সমর্পণ করার জন্য বলি,”অমিতাভ কো ছুঁনা মুশকিল হি নেহি না মুমকিন হ্যায়”।ব্যস আর দেখতে হয় না হইহল্লা শুরু হয়ে যায়।আমি আবার আনমনে প্রকৃতির শোভা দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

এখন আকাশে মেঘ আর নেই।রোদ্দুর ঝলমল করছে।তবে মেঘে মেঘে বেলা বেড়েছে বেশ।রাস্তার ধারে মাইলফলক দেখে বোঝা যায় যে আমরা এবার রাণীক্ষেত শহরের কাছাকাছি চলে এসেছি।রাণীক্ষেত নামকরণের পিছনেও একটি কাহিনী প্রচলিত আছে।কাত্যুরি বংশের রাজা শুদ্ধর্ভদেবের অত্যন্ত প্রিয় রাণীর নাম পদ্মিনী।রাণী এই জায়গার চারণভূমির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যান।রাণীর জন্য রাজা এখানে প্রাসাদ বানিয়ে দিয়েছিলেন যদিও সেই প্রাসাদের অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না।তবে রাণী পদ্মিনীর স্মৃতিতে লোকমুখে এই জায়গা রাণীক্ষেত নামে পরিচিত হয়ে আছে।এই এলাকা ক্যান্টনমেন্ট নামেও পরিচিত,ব্রিটিশরা এখানে কুমায়ুন রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেছিল।বর্তমানে নাগা রেজিমেন্টর জন্যও ক্যান্টনমেন্ট তৈরি হয়েছে।রাস্তাঘাটের পরিচ্ছন্নতা, শহরের নকশা দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এটা সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রাধীন এলাকা।আর্মিস্কুল,কম্যান্ড হসপিটাল আছে এই শহরে।আমাদের বাস ক্যান্টনমেন্ট এলাকার পাশ দিয়ে যাচ্ছে।জানলা দিয়ে চোখে পড়ছে প্যারেড গ্রাউন্ড, বাস্কেটবল কোর্ট আরও টুকরো দৃশ্য।চলতে চলতে আমরা পেরিয়ে যাই কুমায়ুন রেজিমেন্টাল সেন্টার মিউজিয়াম।সেনাবাহিনীর এই সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে কুমায়ুন রেজিমেন্টের সাফল্যের স্মারক,শহীদদের স্মৃতিজড়ানো ইতিহাস।এখানে আমাদের নামা হয় না।ইতিহাস অধরা রয়ে যায় আমাদের কাছে।ক্রমশ শহর পার হয়ে আমরা আবার অরণ্যপথে ঢুকে পড়ি।রাস্তায় ইতিউতি বনরক্ষীদের আউট পোস্ট।কিছু সময় পর অবশেষে বাস থামে।

এখানেই আছে বিখ্যাত গলফ কোর্স।এশিয়া উচ্চতম গলফ কোর্সের মধ্যে অন্যতম।ভারতে দ্বিতীয় বৃহত্তম।বাস থেকে নেমে চোখ জুড়িয়ে যায়।মসৃন রাস্তার দুপাশে ওক পাইনের বন।সামনে খানিকটা দূরে দেখা যাচ্ছে সবুজ তৃণভূমি।বোঝা যায় ওটাই গলফ কোর্স।মাঠে পা রাখলে মন সবুজ হয়ে ওঠে।এই তৃণভূমি পুরো সমতল নয়।অল্প ঢালু হয়ে কিছুটা গড়িয়ে সমান্য সমতলের পর আবার ঢাল।

ছবি তোলার পক্ষে আদর্শ জায়গা।ফলে সকলের চোখ এখন মোবাইল স্ক্রিনের দিকে।ঠান্ডা হাওয়া বইছে সাথে মাঠ জুড়ে রোদ্দুর ওম ছড়াচ্ছে,সবুজ ঘাস আয় আয় বলে ডাকছে।যে যার মতো ঘুরে বেড়াকগে যাক, আমরা কয়েকজন রোদ পোহানোর জন্য ঘাসে গা এলিয়ে দিই। সামান্য আবর্জনা দূরে থাকুক কোথাও এক টুকরো কাগজ পর্যন্ত পড়ে নেই দেখে বোঝা যায় যে,জায়গাটা সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে আছে।অবশ্য ঢোকার আগে বোর্ডে হিন্দিতে লেখা চেতাবনী আছে। মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে,য়হ সৈন্য ভূমি হ্যায়,কৃপয়া কুড়া কেবল কুড়াদান মে হী ডালে,খেল কে সময় মৈদান মে প্রবেশ বর্জিত হ্যায়,ইত্যাদি ইত্যাদি। নীচে ইংরেজি তে লেখা,ক্যান্ট বোর্ড রাণীক্ষেত।

লাঞ্চ আওয়ার পেরিয়ে যাচ্ছে তাই এবার বাসের থেকে তাগাদা আসে রওনা হওয়ার জন্য।আমরা তখনও রাণীক্ষেতের ঘাসের বিছানায় রাজার মতো আধশোয়া হয়ে রিল্যাক্স মুডে গল্পে ডুবে।কেউ একজন চেঁচিয়ে বলল,”খেতে হবে না! আর্ট মেরে বসে থাকলে হবে? ” মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিমায় হাত নেড়ে ভবানী উত্তর দিল, “ধুউস। আগে আর্ট,খাওয়া পরে”।পরবর্তী কালে ভবানীর এই ডায়লগ বেশ হিট করে যায়।ছোটোখাটো খুনসুটি করতে করতে আবার সকলে বাসমুখী হই।মিনিট দশেক পর একটা ধাবার সামনে বাস দাঁড়ায়।গাড়ি থেকে রান্না করা খাবার নামানো হয়। ধাবার টেবিল চেয়ারে দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করেন হারুদা।খাওয়া শেষে পাশের কালিকা মন্দিরে যায় সবাই।এখানেও কয়েক ধাপ উপরে উঠতে হয়। আমি উঠি না,নীচেই অপেক্ষা করি।এখানে মুসাম্বি লেবুর রস বিক্রি হচ্ছে।যারা উপরে যায়নি তাদের অনেকে রসাস্বাদনে সময় কাটাচ্ছে।গুটিকয়েক দোকান,ধাবা ছাড়া জনবসতি দেখা যায় না।জায়গাটা খুবই নির্জন।রস বিক্রেতার সাথে কথা বলে জানা গেল সন্ধ্যার পর এই জায়গা নিরাপদ নয়।এটাই চিতাবাঘের চলাচলের রাস্তা।অতি উৎসাহী কেউ বলল এখান থেকে সন্ধ্যার পরে রওনা হলে বাঘ দর্শন হয়ে যেত।তবে মন্দিরে দেবী দর্শন করে যারা এলেন তারা এই প্রস্তাবে মোটেই উৎসাহ দেখালেন না।এ যাত্রা বাঘ দেখার পরিকল্পনা মুলতুবি রেখে সবাই বাসে উঠে পড়ল।
বিকেল যখন নিভে আসার সময় হয়েছে তখন সবার চা তেষ্টা পায়।বাস থামে উত্তরাখন্ড হস্তশিল্প দোকানের সামনে।উল্টো দিকে চায়ের দোকান।গরম পকোড়া আর চা শীতের হাত থেকে কিছুটা রেহাই দিল।চায়ের পর উল্টোদিকের দোকানে যাওয়া হল।এখানে রডোডেনড্রন স্কোয়াশ,বিভিন্ন, আচার,ফ্রুট জ্যাম বিক্রি হচ্ছে।কেউ কেউ কিনলেন।

সন্ধ্যার মুখে আবার বাস ছাড়ল।চারপাশ জুড়ে অন্ধকার। বেশ খানিক পর দূরে কয়েকটা ছোটোছোটো আলোর বিন্দু নজরে পড়ল।বাস যত এগোতে থাকে বিন্দুর সংখ্যা এবং ঔজ্জ্বল্য বাড়তে থাকে।বোঝা যায় আমরা নৈনিতাল শহরের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছি।বাস আমাদের যেখানে নামিয়ে দিল সেখানে অবশ্য আলোর খুব অভাব।দুটোমাত্র দোকানে টিমটিম করে আলো জ্বলছে।জানা গেল সন্ধ্যার পর বাস শহরের মধ্যে ঢুকবে না।

এখান থেকে ছোটো গাড়িতে হোটেল পর্যন্ত যেতে হবে।যস্মিন দেশে যদাচার এই ভেবে মালপত্তর নিয়ে ছোটো গাড়িতে উঠে পড়ি।হোটেলের সামনে এসে থমকাই।খাড়া সিঁড়ি উঠে গেছে প্রায় দোতলার সমান।কষ্টেসৃষ্টে রিশেপশনে পৌঁছে জানা যায় আমাদের ঘর তিন তলায় এবং লিফট নেই।অগত্যা….
(ক্রমশ)
ছবিঃ সুপর্ণা রায়চৌধুরী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here